আমাদের বীরগাথা

ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি আবদুল করিম এবং প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগমের সন্তান বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিনের জন্ম ১৯৩৯ সালের ৩ ডিসেম্বর। জন্ম ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া থানার টুপারিয়া গ্রামে। হেমায়েত উদ্দিনের অপর দুই ভাই নজির হোসেন, সামসুল হক ও ছোট বোন মোমেনা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য হেমায়েত উদ্দিনের প্রথম স্ত্রী হাজেরা বেগম আত্মাহুতি দেন। ১৯৫৯ সালের ২৮ অক্টোবর গোপালগঞ্জ শহরে এক নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে হেমায়েত উদ্দিন ‘সিপাহী’ হিসেবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ লাভ করেন। পরবর্তীতে জুনিয়র অফিসার ‘নায়েব সুবেদার’ হিসেবে প্রমোশন পান। ১৯৭১ সালে নায়েব সুবেদার হেমায়েত উদ্দিন ছিলেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ আর্মি স্কুল অফ মিউজিকের একজন ইন্সট্রাকটর।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি স্ত্রী ও ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর তিনি গাজীপুরে যান তার প্যারেন্ট ইউনিট সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিতে। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর হেমায়েত উদ্দিন কিছু সেনা সদস্যকে নিয়ে নিজ জেলা ফরিদপুরে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বীরযোদ্ধা ‘হেমায়েত বাহিনী’ নামে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালের ১৫ মে মাসে তিনি বাহিনীটি গঠন করেন বরিশাল জেলার গৌড়নদীর বার্তা হাই স্কুলে। ‘হেমায়েত বাহিনী’ যুদ্ধ করেছে ফরিদপুর-বরিশাল রণাঙ্গনে। পরবর্তীতে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এই বাহিনীকে তার সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ১৪ জুলাই-রামলীলের যুদ্ধে নায়েব সুবেদার হেমায়েত উদ্দিন আহত হন।

দেশ স্বাধীনের পর নায়েব সুবেদার হেমায়েত উদ্দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নাই। কারণ তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাই তিনি মনে করেন একজন বিদ্রোহী সেনা সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করা ঠিক হবে না। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নায়েব সুবেদার (অব.) হেমায়েত উদ্দিনকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
………………………………………….

২৮ এপ্রিল আমার গ্রামের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান সবার সাথে দেখা হলো। কিন্তু গ্রামে পৌঁছে দেখি পাকিস্তান মিলিটারির হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। এমনকি আওয়ামিলীগের নেতার ঘরেও। ২৯ তারিখ সকাল বেলা আমি নাস্তা করছি এমন সময় সিগারেটের কাগজে লেখা একটি চিরকূট পেলাম।

তৎকালীন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আবদুল আজিজ সাহেব ওই চিরকূটে লিখেছেন ‘ছোট ভাই হেমায়েত, জানতে পেলাম তুমি সদলবলে অস্ত্রসহ গ্রামে এসেছ। আমাদের প্রায় ৩০/৩৫ জন নেতাকর্মীকে থানায় আটকে রেখেছে। আজ বিকেলে পাকিস্তান আর্মি আসবে এবং আমাদেরকে তাদের কাছে হ্যান্ডওভার করা হবে। হ্যান্ডওভার করা হলে কি হবে বুঝতে পারছ? আমাদেরকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলবে। ভাই, তুমি যদি পার আমাদের জীবন বাঁচাও।’

এই চিঠি পাওয়ার পর কিসের আর নাস্তা করা! আমি বললাম, ‘নাস্তা রাখ। হোল্ড আপ। গেট রেডি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বন্দী আছেন। তাদের মেরে ফেললে আমরা কাদেরকে নিয়ে যুদ্ধ করব। আমরা সেনাবাহিনীর লোক। আমাদেরকে তো কেউ চেনে না। যুদ্ধের জন্য ভবিষ্যতে এই নেতা-কর্মীদের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন হবে।’ আমি তৎক্ষনাৎ থানার অভিমুখে রওনা হলাম।

থানার সামনে কোটালিপাড়া ডাকবাংলায় গিয়ে থানার দিকে মুখ করে মেশিনগান তাক করলাম। আমার কাছে মেশিনগান, মর্টারগান, এসএমজি, এলএমজি সব ধরনের অস্ত্রই ছিল। থানার দিক থেকে আমি কোন বাধাই পেলাম না। খুব সহজেই থানায় গিয়ে তালা খুলে সব নেতাকর্মীকে উদ্ধার করলাম। তাদেরকে বললাম দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করতে। আমিও কাজ শেষে সহজেই সদলবলে ওই স্থান ত্যাগ করলাম।

এই অবস্থা দেখে এখানকার থানা ও মহুকুমা প্রশাসকসহ যারা সরকারি চাকরি করত তারা বলল ‘সর্বনাশ! আর্মিরা এসে এসব দেখলে আমাদেরকে তো বাঁচতে দেবে না। হেমায়েতকে ধরার ব্যবস্থা কর।’ তখন তারা মিটিং করে আমাকে দলবলসহ ধরার চেষ্টা করল এবং আমার বিরুদ্ধে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিল। তারা বলে বেড়াতে লাগল ‘হেমায়েত তো তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে। না হলে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার সময় স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে কেন? ও যদি আমাদের কাছে ধরা না দেয় তাহলে ওর স্ত্রীকেই পাকিস্তানিদের কাছে ধরিয়ে দেয়া হবে।’

ওদের এই পরিকল্পনার কথা আমার স্ত্রী জেনে যায়। তখন সে হয়তো ভেবেছে ‘পাকিস্তানিরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করবে। তার চাইতে মরে যাওয়া ভালো।’ নিজের ইজ্জত রক্ষা করতে ১৯৭১ সালের ১ মে আমার স্ত্রী হাজেরা বেগম আত্মাহুতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধে আমি যেন পূর্ণ অবদান রাখতে পারি, সেজন্য আমার স্ত্রী শাহাদাত বরণ করার মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করল এবং আমারও কোন পিছুটান রাখল না। আমাকে গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনার হোতা ছিল চাঁন মিয়া সহ আরো পাঁচজন। হাজেরার লাশ দাফনের পর আমি মে মাসের ৩ তারিখে চাঁনমিয়াকে গুলি করে মেরে ফেলি। কারণ তারা ওই পরিকল্পনা না করলে আমার স্ত্রী মারা যেত না, আমার বাচ্চাটা এতিম হতো না।  

৩ তারিখেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা আমার বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। এটা দেখে ওই রাতেই আমার সঙ্গীরা আমাকে ফেলে চলে গেল। শুধু হাবিলদার সোলেমান ও হাবিলদার ইব্রাহীম খান আমার সাথে রয়ে গেল। আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা জানার পর আমি প্রতিশোধস্পৃহায় আরো জ্বলে উঠলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ৫ তারিখে আমার সঙ্গে থাকা দুইটি ছেলেকে নিয়েই আমি কোটালিপাড়া থানা আক্রমণ করব।

এই অপারেশনে যাবার আগে আমি পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন খানের ছদ্মবেশ ধারণ করলাম। এই অপারেশনের ব্যাপারে আমাকে নানাভাবে মুন্সি আবুল কাশেম সাহেব ও তার ছেলেরা সাহায্য করেন। তারা যুদ্ধ করতে জানেন না তাই আমাদের সাথে অপারেশনে যেতে পারলেন না। আমাদের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন ‘আল্লাহ এরা থানা আক্রমণ করতে যাচ্ছে। কি হবে জানি না! তুমি যদি এদেরকে জয় না দাও তাহলে আর বাংলা রেখো না।’ আরো কিছুু সাধারণ জনগণ আমাকে গোপনে সহযোগিতা করতে থাকে। আমি কোটালিপাড়ায় এসে দেখি প্রতিটা ঘরে পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে।

কোটালিপাড়া থানা অ্যাটাকটা ছিল অভিনব একটি নাটকের মতো। আমি ক্যাপ্টেনের খাকি পোশাক পরে নিলাম। দুই জন হাবিলদার আমার দুই পাশে বডিগার্ড হিসেবে রইল। থানার সিপাহি ডিউটিতে ছিল। আমার স্ত্রী নির্যাতনের ভয়ে আত্মহত্যা করেছে, আমার বাড়িঘর পাকিস্তানিরা পুড়িয়ে দিয়েছে, আমি পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে গোপন জায়গায় চলে গেছি, আমার এত বিপর্যয়ের পরও যে আমি থানা আক্রমণ করতে আসব এটা ওরা কেউ কল্পনাও করতে পারে নাই। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছিল মৃত্যু ও বিজয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ওদেরকে মেরেই চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেব।

আমি থানায় ডিউটিতে থাকা সিপাহিকে উর্দুতে বললাম, ‘তুম কৌন হো?’ উত্তরে সিপাহী বলল, ‘ম্যায় কাদের হু।’ তখন বললাম, ‘কেয়া কাদের হ্যায়? বাতাও হেমায়েত কাহা হ্যায়? কাহা হ্যায় ও? বোলাও, তুমহারা অফিসার কো। কেয়া হ্যায় অফিসারকা নাম?’ আমি এত জোড়ে জোড়ে উদূর্তে কথা বলছিলাম যে সিপাহিটি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘আব্দুল বারেক হ্যায়।’ আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘বোলাও আব্দুল বারেক কো।’ আমার হাকডাকে অফিসার চলে এল। এসেই আমাকে দেখে স্যালুট দিল। আমি জানতে চাইলাম, ‘তুম কৌন হো?’ অফিসার উত্তর দিল, ‘অফিসার ইনচার্জ।’

আমি বললাম, ‘কেয়া অফিসার ইনচার্জ? বাতাও তুমহারা জোয়ান কিধার হ্যায়? ফলোইন কারো।’ তারা সাথে সাথে ফলোইন করলো। থানায় থাকা দুই জন জোয়ান, একজন ওসি, সুনীল বাবু নামক একজন দারোগা, তিন-চার জন জমাদ্দার সবাইকে ফলোইন করানো হলো। তারা সবাই কিন্তু আমাকে ‘ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন খান’ ভেবেই আমার নির্দেশ পালন করছিল। একদম রাইফেল নিয়ে লেফট-রাইট শেষ করে ওরা যখন দাঁড়াল তখন আমি বললাম, ‘তুমলোক ট্রেনিং জানতা হ্যায়?’ তারা উত্তর দিল, ‘জ্বি স্যার, জানি কিছু কিছু।’ আমি বললাম, ‘ঠিক হ্যায় আমি ট্রেনিং করাবো। হামলোগ হেমায়েত কো পাকার কে লে আয়েঙ্গে। ঠিক হ্যায়?’

তারা সমস্বরে বলল, ‘হ্যাঁ সার। জিন্দাবাদ স্যার।’ হঠাৎ বলে উঠলাম, ‘হোল্ড। তুমলোক রাইফেল লেকার আও। আভি হাম দেখেঙ্গে খালি হাত মে তুম ক্যায়সে কারেঙ্গে।’ এই বলে ওদের থেকে অস্ত্রগুলো নিয়ে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখলাম যাতে আমি আক্রমণ চালালে ওরা প্রতিরোধ করতে না পারে। এরপর আমি ওদেরকে ড্রিল করানো শুরু করলাম। বললাম, ‘পা নেহি মিলতা হে। বাঙালি গাদ্দার।’ এভাবে গালাগালি করতে থাকি। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠে একবার ওদেরকে সামনে চলার নির্দেশ দিচ্ছি, আবার ওদেরকে টার্ন করাচ্ছি। অন্যদিকে আমার সাথে যে দুইজন হাবিলদার ছিল ওদেরকে আগেই বলে রেখেছিলাম ‘

আমি সিগন্যাল না দেয়া পর্যন্ত তোমরা গুলি করবে না। প্রয়োজন বুঝে আমি গুলি করার হুকুম দেব। তোমরা শুধু আমাকে ফলো করবে।’ হঠাৎ এক সময় আমি অস্ত্র উঁচিয়ে ওদের সবাইকে বললাম ‘হারামজাদা, আমি হেমায়েত। কি ভাবছোস, তোরা আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে টিকতে পারবি? হাত তোল। সবাই উপরে হাত তোল।’ আমার এই মূর্তি দেখে সবাই তো কাঁপতে কাঁপতে প্রায় পড়েই যায়। এমনই এদের সাহস! অথচ এরাই আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

ওদেরকে তখন বললাম, ‘তোরা বাঙালি বলে আমি তোদের মারবো না। আমি জানি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এগুলো হবেই। কিন্তু মনে রাখবি পরে একসময় তোদেরকেও মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। এদেশের প্রত্যেকেই যুদ্ধ করা লাগবে। না হলে তোদের মা-বাবা, তোদের বংশধর কেউই বাঁচবে না। পাকিস্তানি ওই পাষ-দের তোরা চিনিস না। ওরা তোদেরকেও ছাড়বে না। এখন এখান থেকে পালা। ব্যারাকের মধ্যে যা কিছু আছে সব তেমনই থাকবে। ওগুলোর কিছুতে তোরা হাত দিবি না।’ এই বলে ওদেরকে ভাগিয়ে দিয়ে আমি থানা মুক্ত করলাম।
থানা অপারেশনের পরপরই হাজার হাজার জনতা ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে থানার সামনে আসতে শুরু করল।

জনতার সম্মিলিত কণ্ঠের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে আমিও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলাম। জনতার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আমি হেমায়েত। আমি মুক্তিযুদ্ধ করবো। আপনাদেরকে সাথে নিয়েই যুদ্ধ করবো। কিন্তু সময় লাগবে।’ আমি আরো বললাম ‘আপনাদের মধ্যে যারা পুলিশ বা আর্মিতে চাকরি করেন। ছুটিতে এসে এখানে আটকে গিয়েছেন অথবা যারা ২৫ মার্চের পর পালিয়ে এসেছেন তারা আমার সঙ্গে এসে যুদ্ধে যোগ দেন।’

‘হেমায়েত বাহিনী’ গঠনের পর পূর্ণ উদ্যমে শুরু হলো বিভিন্ন জায়গায় আমাদের অপারেশন। ১৪ জুন হরিণাহাটি অপারেশনে ৩০জন পাকিস্তানি আর্মি গ্রেপ্তার করি। কোটালিপাড়ার রাজালি গ্রামের অনন্ত অধিকারী ও হেমন্ত অধিকারীর বাড়ির পুকুর পাড়ে তাদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে এক কবরে চাপা দেই। এই অপারেশনে আমার বডিগার্ড হাবিলদার ইব্রাহীম শহীদ হয়। তার কথা আমি কখনও ভুলতে পারব না। ছেলেটার বাড়ি ছিল কাপাসিয়া থানায়। ওই ৩০টা পাকিস্তানি আর্মির কবরের পাশেই তাকে কবর দেয়া হয়। এভাবে পরপর বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনের পর একদিন দুর্ভাগ্য এসে হানা দেয়।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ বা ১৫ জুলাই। রামশীলের যুদ্ধে আমি আহত হই। এই অপারেশনে আমার পাশে হাবিলদার মকবুল হোসেন ছিল দলের দুই নম্বর মেশিনগান নিয়ে। হঠাৎ করে একটা গুলি এসে ওর মাথায় আঘাত করে। ওকে দেখার জন্য আমি যখন মুখ ঘুরিয়েছি ঠিক তখনই আমার গালে একটা গুলি এসে লাগে। আমার গালের বাম পাশ দিয়ে গুলিটা প্রবেশ করে উপরের চোয়াল ও দাঁত সহ জিহ্বা কেঁটে গালের ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। আমি মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ছিলাম পাঁচ/সাত দিন। আমার বাহিনীর চিকিৎসক টিমই আমার চিকিৎসা করেন।

এদিকে জানলাম ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট, বুধবার, সাংবাদিক মি. লরেন্স ‘দি লয়াল সান’ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন Hemaet Uddin is a rebel leader. আমাকে নিয়ে এমন একটি কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে জানার পর আমি ভেবে দেখলাম, এটা তো ঠিক যে জনগণের স্বার্থে আমি পাকিস্তানের মতো জাঁদরেল একটি সেনাবহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বের হয়ে এসেছি।

দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ‘হেমায়েত বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। এজন্য আমার মত একজন বিদ্রোহীকে দেশ স্বাধীনের পরে সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করা উচিত হবে না। কারণ সেনাবাহিনীর একজন বিদ্রোহী যদি পুনরায় সেনাবাহিনীর মতো একটি নিয়মানুবর্তী বাহিনীর অংশ হয়ে যায় তবে সেটা বাঙালি জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, দেশকে যদি শত্রুমুক্ত করতে পারি তাহলে আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করব না।  ৩ ডিসেম্বর আমার এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।

সূত্র : ‘৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়’- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন