চলচ্চিত্রে স্পেশাল ইফেক্টঃ বৃষ্টি, কুয়াশা, জোছনা

চলচ্চিত্রে অ্যাকশন দৃশ্য আমরা অহরহই দেখতে পাই। একটা গাড়ির সাথে আরেকটা গাড়ির সংঘর্ষ ঘটে বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়, বিরাট সব ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়, থাকে নায়ক আর ভিলেনের দুর্দান্ত সব মারামারির দৃশ্য। সেই সাথে দেখা যায় বৃষ্টির দৃশ্য অথবা জোছনার আলোয় ভৌতিক কোন দৃশ্য। একটি চলচ্চিত্রের সিংহভাগই ধারণ করা হয় স্টুডিওতে। চার দেয়ালের ভেতরই সেট তৈরি করে, গ্রিন স্ক্রিন ব্যবহার করে এবং স্পেশাল ইফেক্টের সাহায্যে তৈরি হয়।

স্পেশাল ইফেক্ট হল এমন এক কৌশল যা দিয়ে অসম্ভবকে শুধু সম্ভবই না, আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। সেই সাথে এটি কম ব্যয়সাপেক্ষ এবং ঝামেলাও কম।

আধুনিক সায়েন্স ফিকশন মুভির শুরু হয় Matrix-এর হাত ধরে। সেই Matrix-এ পর্দা কাঁপানো সব স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে। Keanu Reeves-এর Bullet Dodging দৃশ্যটি সর্বকালের সেরা স্পেশাল ইফেক্টের মধ্যে একটি হিসেবে ধরা হয়। আর হবেই না কেন, প্রথম আধুনিক সায়েন্স ফিকশন মুভি হিসেবে এমন চোখ ধাঁধানো স্পেশাল ইফেক্টের ব্যবহার তো চাট্টিখানি কথা নয়।

পর্দায় মুষলধারে বৃষ্টির দৃশ্য আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। দেখতে আসল বৃষ্টি মনে হলেও তা আসলে বৃষ্টি নয়, এখানেও রয়েছে স্পেশাল ইফেক্টের কারসাজি। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র Noah-তে আধুনিক সময়ের সেরা ঝড়-বৃষ্টির স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে। চলচ্চিত্রে বৃষ্টি দেখানোর জন্য প্রথমেই দরকার হয় কিছু Rain Bar-এর, এই Bar-গুলো হয় বিশালাকৃতির পানির ট্যাঙ্ক যেগুলো ক্রেন-এর সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মনে হতে পারে যে এভাবে বৃষ্টি তৈরি করা খুব সহজ, কেবল সময়মতো ট্যাঙ্কগুলো ছেড়ে দিলেই তো হল! কিন্তু না, ট্যাঙ্কগুলো একসাথে ছেড়ে দিলে তা থেকে বৃষ্টির মতো করে পানি পড়বে ঠিকই, কিন্তু তা যে নকলভাবে তৈরি সেটা খুব সহজেই বোঝা যাবে। তাই এই ট্যাঙ্কগুলো থেকে পানি ছাড়ার ক্ষেত্রেও অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়। যে ক্রেনগুলো Rain Bar বহন করে, সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে Special Effect Director-এর হাতে। তিনি সময় এবং স্থান বুঝে একেকবারে একেকটি Bar থেকে বৃষ্টি ছাড়ার ব্যবস্থা করেন। সবগুলো Bar একসাথে খুলে দিলে তা বৃষ্টি তো হবেই না, বরং একে দেখাবে অনেকটা কুয়াশার মতো। তাই একেকবারে একেকটি Rain Bar থেকে পানি ছাড়া হয় এবং সেইসাথে পানির ফোঁটাগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়, অর্থাৎ কখনো বড় বড় ফোঁটা, আবার কখনো ছোট ফোঁটায় ছাড়া হয়, ঠিক আসল বৃষ্টির মতো। Noah-তে বৃষ্টির দৃশ্য ধারণ করার জন্য প্রতি মিনিটে প্রায় ৫০০০ গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়েছিল। এখানে যে Rain Bar-গুলো ব্যবহার করা হয়, তার একেকটি ছিল ১০০ ফিট লম্বা এবং ৪০ ফিট চওড়া।

পশ্চিমা দেশগুলোর বেশীরভাগই ঠান্ডার দেশ হয়, অনেকগুলোতে সারা বছর ধরেই বরফ পড়তে থাকে। এই ঠান্ডার দেশগুলোতে কুয়াশাঢাকা পরিবেশ খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু পর্দায় কুয়াশা নিয়ে আসা এতটাও সহজ নয়। মনে হতে পারে যে কুয়াশা তৈরি তো ধোঁয়া তৈরির মতোই, কিন্তু না, কুয়াশা যেমন এক জায়গায় স্থির থাকে, ধোঁয়া তেমন না। ধোঁয়া সবসময় উপরের দিকে উঠতে থাকে, কিন্তু কুয়াশা তা করে না। তাই কুয়াশা তৈরি ধোঁয়া তৈরির মতো এতো সহজ নয়। কুয়াশা তৈরি করা হয় Fog Machine দিয়ে। এই মেশিনে ব্যবহার করা হয় Glycol এবং পানির মিশ্রণ, যাকে Fog Fluid বলে। এই তরলকে উত্তপ্ত ধাতব পদার্থের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে বাষ্পে পরিণত করা হয়। এই বাষ্প সাধারণ বাষ্পের মতো ধোঁয়ায় পরিণত হয়ে উড়ে যায় না, বরং কুয়াশার মতো স্থায়ী হয়। এছাড়াও Fog Machine-এর সাথে Air Conditioner-এর মতো Compressor জুড়ে দেয়া হয়, যার ফলে বাষ্পের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। বাষ্পের তাপমাত্রা যত কম হয়, এটি তত বেশী সময় ধরে স্থায়ী হয়। তাপমাত্রা বাড়ানোর সাথে সাথে তা উপরে উঠতে শুরু করে।

এবার আসা যাক রহস্যময় জোছনা তৈরির গল্পে। ভৌতিক বা থ্রিলার ধরণের চলচ্চিত্রে জোছনা বেশ বড় অবদান রাখে। জোছনার আলোটাই যেন কেমন রহস্যময়, এই আলোতে অবাস্তব যেকোনো কিছুকেও বাস্তব মনে হয়। কিন্তু পর্দায় এই আলো ফুটিয়ে তুলতে পরিচালকদের বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে স্টুডিওর আলো কমিয়ে নিয়ে আলো-আঁধারের খেলাতেই জোছনা তৈরি করা যায়, কিন্তু কৌশলটি এতো সহজ নয়। আগেকার সময়ে দেখা যেত পর্দায় জোছনা মানেই নীল আলো, আসলে নীল আলো চোখে বেশ নরম বলে মনে হয় এবং খানিকটা রহস্যময় লাগে। কিন্তু জোছনা কখনও নীল হতে কেউ দেখেছে কি? তাই প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পরিচালকরা জোছনাকেও পর্দায় নিয়ে আসতে শিখেছেন। পর্দায় জোছনা দেখানোর জন্য পুরো স্টুডিওজুড়ে টাংস্টেন বাতি জ্বালানো হয়। একে নরম বানানোর জন্য চারপাশে আইকা জেল মাখানো বোর্ড বসানো হয়, এই জেলগুলো আলোকে শোষণ করে এবং জোছনার মতো মৃদু আলোতে পরিণত করে। এছাড়াও এখনকার আধুনিক ক্যামেরাতেই জোছনা দেখানোর জন্য Twilight Effect থাকে, এর সাহায্যে দিনের আলোকেও রাতে পরিণত করা যায়, একে Day for Night Effect বলে।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন