প্রুযুক্তি যখন সাঁতারের পোশাকে !

২০০৮ সালের ঘটনাবহুল বেইজিং অলিম্পিকে চমকে ওঠার মত অনেক ঘটনাই ঘটে। সাঁতারের ক্ষেত্রে যেমনটা ছিল মাইকেল ফেলপ্‌সের টানা আটটা স্বর্ণপদক জয়। পৃথিবী জুড়ে সবাই যখন এ অবিশ্বাস্য রেকর্ডের জন্য ফেলপ্‌সের বিশেষ সাঁতার দক্ষতাকে বাহবা দিতে ব্যস্ত, তখন কিছু সমালোচকের দাবি ছিল, ‘এসবই লেজার স্যুটের কীর্তি !’      

তাদের এ দাবিটি অবশ্য একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কারণ সেবার যেসব সাঁতারু পদক জিতে ছিলেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৯৮ জন ‘এলজেডআর’ (LZR ) কিংবা ‘লেজার’ নামক এক বিশেষ স্যুইম স্যুট ( Swim Suit ) ব্যবহার করেছিলেন। স্বর্ণপদক জয়ীদের ক্ষেত্রে হিসাবটা একশ জনের মধ্যে চুরানব্বইয়ে এসে দাঁড়ায়। তার মানে, এ স্যুট পরনে থাকলে পদক অনেকটাই নিশ্চিত !

যেভাবে শুরু

লেজার স্যুটের কাজ মূলত শুরু হয় ২০০৪ সালের গ্রিস অলিম্পিকের পর। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পিডো’ বিশেষ সাঁতার পোশাক নির্মাণের জন্য মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাকে প্রস্তাব দেয়। স্পিডোর দাবি, নাসার কারিগরি সহায়তা পেলে তারা এমন এক বিশেষ পোশাক তৈরি করা সম্ভব হবে যা পানিকে প্রতিহত করে শরীরকে ভেসে থাকতে সাহায্য করবে। শুধু তাই-ই নয়, সারা শরীরের পেশিতে যাতে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক থাকে সেটাও এ স্যুট নিশ্চিত করবে। 

সব শুনে নাসা এ প্রকল্পে সম্মতি জানায়। ওদিক থেকে এগিয়ে আসে অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অফ স্পোর্টস এবং ইতালিয়ান প্রতিষ্ঠান মেকটেক্স। দীর্ঘ চার বছর কাজ করার পর অবশেষে ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি স্যুটটি বাজারজাত করা হয় এলজেডআর নামে।

সাঁতারুদের প্রিয়

পলিইউরেথেন ( PU )ইলাস্টেন-নাইলনের ( Nylon 6,6) মিশ্রণে তৈরি পোশাকটি পরে সাঁতার কাটার পর মাইকেল ফেলপ্‌স তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে, ‘এটা পরে পানিতে নামার পর নিজেকে রকেটের মত শক্তিশালী মনে হচ্ছিল ! ’         

পণ্যটির প্রচারণায় স্পিডো জানাতে থাকে, এ পোশাক পরলে সাধারণের চেয়ে শতকরা দুই শতাংশ সাঁতারের টাইমিং কমানো সম্ভব। ফলে ২০০৮ সালের অলিম্পিকের আগে এ স্যুট সাঁতারুদের কাছে রীতিমত হটকেকে পরিণত হয়।

বেইজিং অলিম্পিকে সাঁতারুরা বিশ্ব রেকর্ড নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলায় মেতে ওঠেন। এ বিভাগে সেবার যে ২৫টি নতুন রেকর্ড হয়, তার মধ্যে ২৩টিতে প্রতিযোগীরা লেজার স্যুট পরেছিলেন। পরের বছরেও এ দাপট বজায় থাকে। ২০০৯ সালের আগস্টে এসে দেখা যায়, সাঁতার জগতে যে ৯৩টি নতুন রেকর্ড হয়েছে তার বেশিরভাগেই এলজেডআর সুইম স্যুট ব্যবহার করা হয়েছে।

অতঃপর বিপর্যয়

বাংলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত যে ' বেশী ভালো ভালো না '।  লেজার স্যুটের এমন অহরহ ব্যবহার এবং রেকর্ড ভাঙতে দেখে স্বাভাবিকভাবে অনেকে বিরক্ত হয়ে যান। সাঁতারপ্রেমীরা দাবি করতে থাকেন, এটা একধরনের ‘প্রযুক্তিগত ডোপিং’। এমনকি বেশি ফলের আশায় কোনো কোনো সাঁতারু দুই-তিনটি স্যুট পরেও পানিতে নেমেছেন।

অবশেষে সাঁতারের বিশ্ব সংস্থা ফিনা ( International Swimming Federation ) শেষ পর্যন্ত সাঁতারের পোশাকের নিয়ম বদলাতে বাধ্য হয়। নতুন নিয়ম অনুসারে, পুরুষ সাঁতারুরা কেবল নাভির নীচ থেকে হাঁটু পর্যন্ত পোশাক পরতে পারবেন। এর ফলে এলজেডআরের মতো পুরো দেহব্যাপী পোশাকগুলো নিষিদ্ধের খাতায় চলে যায়।

এরপর অবশ্য স্পিডো নতুন নিয়ম অনুসারে ‘ফাস্ট স্কিন থ্রি ’ নামে একটি সাঁতারের পোশাক বাজারে ছাড়ে। কিন্তু এটি আগের মতো তা হৈচৈ ফেলতে পারেনি।

 

 

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন