‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’ রিয়্যালিটি শোগুলোতে যা হয়

আকাশ থেকে ১০০-১৫০ ফুট উঁচুতে উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে দড়ির মই ঝুলছে। মইতে বাঁধা নানা রঙের পতাকা। একজন মানুষ সেই মই থেকে খুব ঝুঁকি নিয়ে সেই মই থেকে পতাকাগুলো সংগ্রহ করছেন। এই পতাকা সংগ্রহ করাটাই খেলা। এর মাধ্যমে তিনি পাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত পয়েন্ট। নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্ক্ষিত পয়েন্ট সংগ্রহ করতে পারলেই তিনি যাবেন পরের রাউন্ডে।

অথবা আরেক প্রতিযোগীর জন্য চ্যালেঞ্জ তিনি একটি বাক্সে শুয়ে থাকবেন। তার উপর দুই থেকে আড়াই হাজার তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই বাক্সে তাকে শুয়ে থাকতে হবে দুই মিনিট। যেই প্রতিযোগী বেশি সময় ধরে শুয়ে থাকতে পারবেন তিনিই জয়ী হবেন সেই চ্যালেঞ্জে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে টানটান উত্তেজনার এ ধরনের দৃশ্য টিভি পর্দায় হরহামেশাই দেখি আমরা। প্রিয় পাঠক বলছিলাম, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ভয়ংকর ও বিদঘুটে খেলার চ্যালেঞ্জিং রিয়্যালিটি শোগুলোর কথা।

এ ধরনের রিয়্যালিটি শোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় শো হচ্ছে ফিয়ার ফ্যাক্টর (Fear Factor)। ডাচ সংস্করণ Now or Neverland থেকে Endemol USA ও NBC দ্বারা অভিযোজিত আমেরিকান এই রিয়্যালিটি শো প্রথম প্রচারিত হয় ২০০১ সালে। ২০০৬ সালে এর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় এটি ২০১১ সালে চালু হয়।

সম্প্রচার আবার বন্ধ করে দেয়া হয় ২০১৩ সালে। খ্যাতনামা আমেরিকানরা ৫০ হাজার ইউএস ডলারের পুরস্কারের জন্য এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করতেন। তবে যে ব্যাক্তি বা যে দল খেলায় জয়ী হয় তারা ছাড়া অন্য কেউ কোন পুরস্কার বা টাকা পায় না এই শােতে। শোতে বিজয়ীর জন্য ট্যাগলাইন থাকে 'evidently, fear is not a factor for you'.

ফিয়ার ফ্যাক্টর শো-এর প্রতিটি সিজনের এপিসোডগুলো তিনটি ভাগে বিভক্ত থাকে। প্রথম বিভাগটি শারীরিক কসরত। যেমন এক উঁচু ভবন থেকে আরেকটি উঁচু ভবনে লাফ দেয়া। মই বা দড়ি দিয়ে সংযুক্ত ১৫-২০ তলা উঁচু দুটি ভবনের এক ছাদ থেকে অপর ছাদ পার করা প্রভৃতি। যেই প্রতিযোগী দল বা ব্যাক্তি চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বা অন্যদের চেয়ে বেশি সময় নেয় তারা তৎক্ষণাৎ প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়েন।

দ্বিতীয় ভাগে সাধারনত মনস্তাত্ত্বিক কোন চ্যালেঞ্জ থাকে। খুব প্রচলিত তিন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জ হল-
• Eating stunts,
• Animal stunts and
• retrieval/transfer stunts

Eating বা খাওয়ার যেই স্টান্ট থাকে তাতে সাধারণত পোকামাকড় বা কোন পশুর শরীরের অঙ্গ বা গা ঘিনঘিনে খাবার খেতে হয়। কেউ খেয়ে শেষ করতে না পারলে বা বমি করে দিলে তিনি সেই চ্যালেঞ্জে হেরে যান।

Animal stunt-এ সাধারণত যে কোনো পশুর মোকাবেলা করতে হয়। বাঘের মুখের সামনে থেকে মাংসের টুকরা ছিনিয়ে আনা থেকে শুরু করে মুখের মধ্যে শরীরে মধু লাগিয়ে মৌমাছি বসানোরও চ্যালেঞ্জও হতে পারে। অথবা এক বাক্স ইঁদুর বা পোকার মধ্যে শুয়ে থাকার খেলাও খেলতে হয় প্রতযোগীকে।

Retrival/transfer স্টান্টে সাধারনত দেখা যায় অনেকগুলো সাপের মধ্য থেকে কোন একটি পতাকা বা বল খুঁজে আনতে হবে। অথবা মুখ দিয়ে যে কোনো পশুর রক্তমাংশের ভেতর থেকে কিছু খুঁজে বের করে আনতে হয়। কখনোবা টিয়ার গ্যাস পূর্ণ একটি কক্ষে বসে থাকতে হয় প্রতিযোগীকে।

তৃতীয় ভাগে আবারও শারীরিক কোন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে। যেমন চলন্ত গাড়িতে হঠাৎ আগুন ধরে যাওয়া, অনেক উঁচু থেকে বরফ শীতল পানিতে লাফ দেওয়া।

এই ভাগটি উচ্চতা, পানি, যানবাহন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। রিয়্যালিটি শোয়ের এই অংশটি সবচেয়ে বেশি কঠিন হয়। বিভিন্ন এপিসোডে এ ধরনের বিভিন্ন ধরনের বিপদজনক ভয়ংকর স্টান্ট নিয়ে হাজির হয় ফিয়ার ফ্যাক্টর।

চলুন এবারে জেনে নেয়া যাক যাক এসব রিয়্যালিটি শো নির্মাণের গোপন সূত্রগুলাে :

প্রতিটি প্রতিযোগী এখানে অংশগ্রহনের আগে এই মর্মে চুক্তিতে সই করেন 'if I die the producer is not liable'. যদিও সকল প্রতিযোগী এই চুক্তিতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, তবু্ও তাদের সব ধরনের নিরাপত্তার দিকে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখা হয়।

তবে টিভিতে যখন তাদের আহত দেখানো হয়, তখন তারা সত্যিই আহত হন। প্রতিটা স্টান্ট আগে থেকে পরীক্ষা করে নেওয়া হয় এবং অভিজ্ঞদের দিয়েই সম্পন্ন করা হয়। যদি সেগুলো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে থাকে তখনই সেগুলো প্রতিযোগীদের দিয়ে করানো হয়।

পোকামাকড় খাওয়া ও বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে শুয়ে বসে থাকার ক্ষেত্রে প্রাণীগুলোকে বা পোকামাকড়গুলোকে বিষমুক্ত করা হয় যেন সেগুলো কোন ধরনের ক্ষতির কারণ না হয়।

পোকা খাওয়ার যে স্টান্টগুলো থাকে, প্রতিযোগীরা সত্যিই সেগুলো খেয়ে থাকেন। তবে মাঝে মাঝে সেগুলোকে আরও বিদঘুটে দেখানোর জন্য তাতে ফুড কালার বা কর্ণ ফ্লাওয়ার মিশানো হয়।

তবে এই বিদঘুটে খাবারগুলো অধিকাংশই সত্যি সত্যিই কোন বিশেষ রেস্তোঁরার ফুড ম্যানুর অর্ন্তভুক্ত। ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। যেমন ধরুন একটি পর্বে একজন প্রতিযোগীকে ১০ বছরের পুরনো কাঁচা ডিম খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু পুরনো কাঁচা ডিমের এই রেসিপিটি চাইনিজদের একটি প্রচলতি খাবার যার নাম 'salted duck egg' ।

তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে পোকামাকড় নিয়ে খাবারের অনেক রেসিপি আছে। সেগুলোই মূলত এই শোতে ব্যবহার করা হয়। আর এর বাইরে এমন খাবার স্টান্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয় যা প্রতিযোগীদের দেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়।

ভয়কে জয় করার এই খেলাটির সংস্করণ বিশ্বের ৩৯টি দেশে প্রচারিত হয়। তার মধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বর্তমানে 'Khatro Ke Khiladi' নামে ফিয়ার ফ্যাক্টর-এর একটি সংস্করণের ছয় নম্বর সিজন প্রচারিত হচ্ছে।

অামেরিকার NBC-এর ফিয়ার ফ্যাক্টরের সত্যতা অনেকটা প্রমানিত হলেও ভারতের এই শোটি সত্য না সাজানো তা নিয়ে এখনও তর্ক রয়েছে নির্মাতা মহলে।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন