বহুমুখী পলিহেড্রন

বহুমুখের প্রাণীর কথা আমরা বিভিন্ন গল্পে শুনে থাকি, কিন্তু বহুমুখের বস্তুর দেখা কি কেউ পেয়েছে? আসলে শুনতে যেমনই মনে হোক না কেন, আমরা প্রতিদিনই বহুমুখের জিনিস দেখে থাকি। আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে এদের অসংখ্য উদাহরণ। জ্যামিতিতে এদেরকে বলা হয় পলিহেড্রন, যার বাংলা অর্থ বহুতলক।

পলিহেড্রন শব্দটি মূলত এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। “পলি” শব্দের অর্থ অনেক, আর “হেড্রন” বলতে বোঝায় তল বা মুখ। অর্থাৎ যে বস্তুর অনেকগুলো তল বা মুখ থাকে তাকেই পলিহেড্রন বলা হয়। পলিহেড্রন বা বহুতলক হলো ত্রিমাত্রিক ঘনবস্তু যার তলগুলো সুষম এবং ধারগুলো সরলরৈখিক। কোন বস্তুর অনেকগুলো তল থাকলেও তাঁর কোন তল যদি বাঁকা বা Curved হয় তাহলে তাকে পলিহেড্রন বলা যাবে না।

পলিহেড্রনে কতগুলো তল রয়েছে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তলের সংখ্যার উপর ভিত্তি করেই মূলত এদের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। তিনটি তল বিশিষ্ট পলিহেড্রনকে বলা হয় ত্রিভুজ (Triangle)। সাত তলবিশিষ্ট পলিহেড্রনকে বলা হয় হেপ্টাগন। যে সমতল পার্শ্বে দুটি তল মিলিত হয় তাকে বলা হয় ধার (Edge)। আর যে বিন্দুতে দুই বা ততোধিক ধার মিলিত হয় তাকে বলা হয় চূড়া (Vertex)।

জ্যামিতির প্রতি মানুষের আগ্রহের কারনেই পলিহেড্রন সম্পর্কে গণিতবিদরা গবেষণা শুরু করেন। পলিহেড্রনের তল, ধার ও চূড়ার মাঝে সম্পর্ক বের করেন বিখ্যাত সুইস গণিতবিদ ইউলার। কোন পলিহেড্রনের তলের সংখ্যা f, ধারের সংখ্যা e এবং চূড়ার সংখ্যা v হলে ইউলারের সমীকরণ অনুযায়ী 

v + f − e = 2

অর্থাৎ তল ও চূড়ার সংখ্যার যোগফল থেকে ধারের সংখ্যা বিয়োগ দিলে ফলাফল হবে ২। কোন পলিহেড্রনের উল্লেখিত ৩টি বৈশিষ্ট্য এর মাঝে ২ টি জানা থাকলে আমরা ইউলারের এই সমীকরণ দ্বারা অপর বৈশিষ্ট্যটি বের করতে পারবো।

ইউলার ছাড়াও অনেক বিখ্যাত দার্শনিক পলিহেড্রন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তাদের মাঝে প্লেটো এবং আর্কিমিডিস অন্যতম। প্লেটো যে ধরনের পলিহেড্রন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তাদেরকে বলা হয় প্লেটোনিক পলিহেড্রন। একইভাবে আর্কিমিডিসের পলিহেড্রনকে বলা হয় আর্কিমিডিয়ান পলিহেড্রন

কাগজ দিয়েও পলিহেড্রন বানানো যায়, তবে সে জন্য নেট সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। পলিহেড্রনের বিভিন্ন ধার খুলে তাকে শেষ পর্যন্ত পাটির মত অবস্থায় আনতে পারলে তাকে বলা হয় নেট। নেটে পলিহেড্রনের সকল তল উপস্থিত থাকে, তবে তাদের মাঝে কিছুটা কৌণিক দূরত্ব থাকে। নেট এমন একটি সমতল গঠন যাকে এর ধার বরাবর ভাঁজ করে আবার পলিহেড্রনে পরিণত করা যায়। তাই কোন পলিহেড্রনের নেট সম্পর্কে জানা থাকলে সেটি কাগজে বানিয়ে ভাজ করে পলিহেড্রন তৈরি করা যাবে।

প্রকৃতিতে দেখা মেলে বিভিন্ন বহুতলকের। কোন কোনটা আবার রূপ নেয় প্রচলিত তারকার মতো। ঘনক ও অষ্টলতকের প্রত্যেককেই পাওয়া যায় স্ফটিকরূপেযেমন ক্যালসিয়াম, টাইটেনিয়াম, অক্সিজেন ও সিলিকনের যৌগ বহুতলক স্ফটিকের বেশ ভালো একটি উদাহরণ।

রসায়নেই শুধু নয়, বহুতলকের আধিপত্য রয়েছে জীববিজ্ঞানেও। Circogonia icosahedra প্রাণীর দেহের কাঠামো সুষম বহুতলকের মতো। এছাড়া, এইচআইভি ভাইরাসের গঠন বহুতলাকার। আমরা মৌচাকে ষড়ভূজাকার মুখ দেখে থাকি। কিন্তু মৌচাকের অভ্যন্তরীণ গঠন হয় রম্বিক ডোডেকাহেড্রন আকারের। একই ধরণের আকৃতি দেখা যায় বেদানা বা ডালিমের অভ্যন্তরের কোষের মধ্যে, বিশেষ করে যখন কোষগুলো বড় হতে থাকে। এছাড়া, ভীমরুলের বাসার আকৃতিটা হচ্ছে ষড়ভূজী প্রিজমের মতো।

স্থাপত্যজগতেও বহুতলকের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে বেইজিং-এ নির্মিত ওয়াটার কিউবটা ছিল একটি বহুতলক।   

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন