বেড়াই বাংলাদেশে : পর্ব ২

রূপে বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় এলাকা উত্তর বঙ্গ আর  সিলেট। গত লেখায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল আর খুলনা শহরের কিছু দর্শনীয় স্থানের কথা বলা হয়েছিল। এবারে বলা হবে উত্তরবঙ্গের দুই বিভাগীয় শহর- রাজশাহী ও রংপুর আর উত্তর-পূর্ব দিকের সিলেট শহরের কিছু দর্শনীয় স্থান নিয়ে।

রাজশাহী: 
রাজশাহী সেই আদিকাল থেকেই বাংলার অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তাই ইতিহাসের পাঠ দিতে আপনার সোনামনিদের নিয়ে যেতে পারেন রাজশাহী। আর আমের শহর হিসেবেও রাজশাহীর সুনাম রয়েছে। ভারতবর্ষে প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা হয় এই রাজশাহীর জমিদার কংস নারায়ণের আয়োজনে- সেই ষোড়শ শতকে। কংস নারায়ণের স্মৃতি নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে রয়েছে গোয়ালকান্দি জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। গোয়ালকান্দি ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের পাশেই এর অবস্থান। পুঠিয়াকে মন্দিরের শহর বললেও অতিকথন হয় না।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে পুঠিয়ার মন্দিরগুলো তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের একমাত্র এই মন্দির কমপ্লেক্সে রয়েছে পঞ্চরত শিব মন্দির, চৌচালা গোবিন্দ মন্দির, পঞ্চরত গোবিন্দ মন্দির, দোল মঞ্চ, দোচালা ছোট আহ্নিক মন্দির, জগদ্বাত্রী মন্দির, রথ মন্দির ইত্যাদি। সেই সাথে রয়েছে জলাশয় আর জমিদারবাড়ি। পুঠিয়ার হাওয়াখানাও দর্শনীয়। রাজশাহীর তানোর থানায় পাল আমলের বৌদ্ধবিহার, রাজবাড়ি, দূর্গের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। দূর্গাপুর উপজেলার মসজিদগুলোতে রয়েছে মুঘল স্থাপত্যরীতির ছোঁয়া। সারদা পুলিশ একাডেমির পাশেই রয়েছে দু’টি নীলকুঠি। তোহেরপুর পৌরসভায় রয়েছে নিশিন্দারাজের ঢিবি- এককালে কোন এক জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তুপ।

রাজশাহী শহরে একদম জিরো পয়েন্টের কাছেই রয়েছে ভারতবর্ষের প্রথম যাদুঘর- বরেন্দ্র গবেষণা যাদুঘর। এখানে বরেন্দ্র অর্থাৎ বৃহত্তর রাজশাহী এলাকা থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক সব ভাস্কর্য, শিলালিপি, পুঁথি সংরক্ষিত রয়েছে। রাজশাহী শহরের বৃটিশ আমলের রেসকোর্স ময়দানকে এখন পরিণত করা হয়েছে শহীদ কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায়। রাজশাহী শহরে ঘোরাঘুরির আদর্শ সময় শীতকাল, তবে জ্যৈষ্ঠের আম কাঁঠাল খাওয়ার জন্যও গরমকালে যেতে পারেন।

ঢাকা থেকে এসি নন-এসি বাস নিয়মিতই চলাচল করে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে।  রয়েছে আন্ত:নগর ট্রেন। সময় বাঁচাতে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিমানও।

রংপুর: 
রংপুরের জিরো পয়েন্টের কাছে কাছারি কাজার এলাকায় রয়েছে ঊনবিংশ শতকে তৈরি হওয়া কেরামতিয়া মসজিদ। সংস্কার ও দৈনন্দিন ব্যবহারে মসজিদটির আদি রূপ খানিকটা পরিবর্তিত হলেও মসজিদের নির্মাণ শৈলী এর প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দেয়। রংপুর শহরের পাশেই চিকলির বিল। শীতকালে চিকলির বিল পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সাথেই শ্বাশ্বত বাংলা মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর। এ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ,মানচিত্র, দুর্লভ আলোকচিত্র, সে সময় প্রকাশিত বিভিন্ন পোস্টার, পত্র-পত্রিকা, বই ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল প্রর্দশিত হচ্ছে। রংপুর শহরে কারমাইকেল কলেজ ভবনও ঢাকার কার্জন হলে মতোই ইঙ্গ-মুঘল রীতিতে তৈরি হয় বিংশ শতকের প্রথম ভাগে। রংপুরের দেওয়ানবাড়ি সড়কে দেওয়ানবাড়ি জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে ফনীভূষণ মজুমদার । বাড়িটি এখন ব্যবহার করছে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও একটি স্কুল।  রংপুর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে তাজহাট জমিদার বাড়ি। গোপাল লাল রায় এই প্রাসাদটি তৈরি করেন ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে। বর্তমানে এই বাড়িটি যাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মিঠাপুকুরের তিন কাতারি মসজিদ ১৮১০ সালে তৈরি হওয়া চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর এক মসজিদ। রংপুর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে ইটাকুমারি জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। রংপুর কৃষক বিদ্রোহের নেতা শিব চন্দ্র রায় এ জমিদার বাড়ি তৈরি করেছিলেন উনিশ শতকের শেষ ভাগে। পায়রাবন্দ গ্রামে রয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। ঢাকা থেকে এসি-নন এসি বাস রয়েছে রংপুর যাওয়ার জন্য। রেলযাত্রাও কম আনন্দময় নয়।

সিলেট: 
সিলেট শহর প্রকৃতি আর ইতিহাসের সম্মিলনী স্থান। সিলেট শহরের নাম মাথায় এলেই সবার প্রথমে আসে চা বাগানের কথা। সিলেটের চায়ের সুনাম যেমন রয়েছে, তেমনি এই বাগান দেখতেও পর্যটকেরা ভীড় জমায়। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনীছড়া চা বাগানটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৯ সালে। বিমানবন্দর সড়কের এই চা বাগান উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও সিলেটের প্রথম চা বাগান। লাক্কাতুরা চা বাগানটি মালনীছড়া বাগানের ঠিক উল্টোদিকেই। এখানেই সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম, চা বাগানের টিলাগুলোর ঠিক মধ্যিখানে। এছাড়াও সিলেটে আরো বেশ কিছু চা বাগান রয়েছে শহরের অদূরেই, যেমন দলদলি চা বাগান, তারাপুর চা বাগান, খাদিম চা বাগান ইত্যাদি। খাদিম চা বাগানের সাথেই লাগোয়া খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান। এখানে রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি, মুখপোড়া হনুমান, বানর আর মেছোবিড়াল। সিলেটে রয়েছে জলাবন রাতারগুল। জাফলং যাওয়ার পথে গোয়াইনঘাট থেকে নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় লালাখাল টি এস্টেটে। আর জাফলংয়ের পাথুরে নদী তো বেশ বিখ্যাত পর্যটকদের কাছে। সিলেটের রায়েরগাও ইউনিয়নে রায়েরগাও হাওর। নৌ ভ্রমণের জন্য অসাধারণ এই হাওরের চারপাশে গ্রাম আর সবুজ প্রকৃতি এই হাওরকে দৃশ্যময় করে তুলেছে। সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রেই হযরত শাহজালাল (রা)-এর মাজার। আর খাদিমনগর যাওয়ার পথেই পড়ে হযরত শাহপরাণের মাজার। দু’টি স্থানই ধর্মপ্রাণ পর্যটকদের ভীড়ে জমজমাট হয়ে থাকে গভীর রাত অব্দি।

ঢাকা থেকে এসি নন-এসি বাস নিয়মিতই চলাচল করে সিলেটের উদ্দেশ্যে।  রয়েছে আন্ত:নগর ট্রেন। সময় বাঁচাতে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিমানও।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন