শিশুদের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আসক্তি

নগরায়নের থাবায় উধাও হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। ইট, বালু, পাথরের আড়ালে আটকা পড়েছে শিশুদের বর্ণিল শৈশব। গ্রামের শিশুরা খেলাধুলার কিছুটা সুযোগ পেলেও, শহুরে শিশুদের সে সুযোগ কম। এমনকি শহরের স্কুলগুলোতেও এখন মাঠ প্রায় নেই বললেই চলে। কিছু ঐতিহ্যবাহী স্কুল ছাড়া খেলার মাঠ দেখাই যায় না।

শিশুদের দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাটে স্কুলে, আবার মাঠের অভাবে টিফিনের ফাঁকেও খেলার সুযোগ পায় না তারা। অন্যদিকে যানজট, নিরাপত্তাহীনতার কারণে মা-বাবা শিশুকে বাসা থেকে একটু দূরের মাঠে খেলতে নিয়ে যাওয়া বা বেড়াতে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
স্বভাবতই তার অবসর বিনোদনের একমাত্র স্থান হচ্ছে নানা ধরেণর ইলেকট্রনিক ডিভাইস।

ধীরে ধীরে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কম্পিউটার-মোবাইল-ট্যাব গেমসের ওপর। শিশু-কিশোরদের এই অবস্থা বিশ্বব্যাপী মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা মানব মস্তিষ্কের উপর কম্পিউটার গেমস এমন কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা তার জন্য সুফল বয়ে আনেনা। পাশাপাশি এর অনেক ভাল প্রভাবও রয়েছে যা কিছুক্ষেত্রে তাদের কৌশলি করে তুলছে।

চলুন জেনে নেয়া যাক, ইলেকট্রনিক গেজেটের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের মানসিক বিকাশে কী ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে :

১. মস্তিষ্কের দ্রুত প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে।

২. শিশুদের বিলম্বিত বিকাশ ঘটতে পারে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ।

৩. মারাত্মকভাবে ঘুমের ক্ষতি হতে পারে।

৪. প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শিশুর মাঝে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, attachment disorder, মনোযোগ ঘাটতি, bipolar disorder, মনোব্যাধি এবং সন্তানের আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে ।

৫. অনেক সিনেমা, গেমস এবং টিভি শোতে চুরি, স্পষ্টভাবে যৌনতা, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন বা অঙ্গহানি দেখানো হয় যা শিশুকে সহিংস হতে উদ্ভুদ্ধ করে।

৬. উচ্চগতিসম্পন্ন গেমস বা মিডিয়া কনটেন্ট-এর কারণে শিশুর মনঃসংযোগে ঘাটতি দেখা যায়। এতে শিশুর পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়; স্কুলের প্রতিও তৈরি হয় অনীহা।

৭. EMF radiation নির্গমনের ফলে শিশুর মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৮. শিশুদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটতে পারে।

৯. অতিরিক্ত টিভি দেখা বা কম্পিউটারে বসে থাকা শিশুর চোখের জন্যও ক্ষতিকর। অনেকের চোখে সমস্যা দেখা যায়।

১০. অনেক সময় শিশু শুধু কার্টুনের চরিত্রের নেতিবাচক দিকগুলোই শেখে।

১১. স্থূলতা দেখা দিতে পারে। জরিপে দেখা যায়, ভীষণ মোটা বা স্থূলকায় শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩০% শিশুর আয়ু কম হয়। ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও হৃদরোগেও আক্রান্ত হতে পারে তারা। এছাড়া মাথাব্যথাসহ আরও কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে।
 
কী করণীয়:
১. শারীরিকভাবে বিভিন্ন আউটডোর খেলাধুলার প্রতি শিশুদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। 

২. শিক্ষণীয় গেমস নির্বাচন করুন, কার্টুনের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।

৩. শিশুকে সমবয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিন।

৪. সাধারণত শিশুরা যদি দিনের বেশিরভাগ সময় একা থাকে তাহলে গেমসের প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। তাই মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুকে সময় দিন, যাতে সে নিঃসঙ্গ না থাকে।

৫. প্রয়োজনে আপনার ডিভাইসে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখুন।

৬. শিশুর খেলা ও পড়ার রুটিন করে দিন। যাতে তার পড়ার চাপ না পড়ে আর খেলাধুলার পর্যাপ্ত সময় পায়।

৭. শিশুকে মাঝে মধ্যে বেড়াতে নিয়ে যান। এতে তার মানসিক বিকাশ ঘটবে।

৮. শিশুর বয়স অনুযায়ী তাকে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বইপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।

৯. যেসব শিশুর সব কিছুতেই আগ্রহ বেশি, তার আগ্রহ না কমিয়ে বরং রুটিন করে কম্পিউটারে গেমস খেলতে দেয়া উচিত।

১০. আজকাল কিছু ডিভাইসে বা বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাসে Parental Control নামে একটি অপশন দেয়া থাকে। যার মাধ্যমে মা-বাবারা তাদের সন্তানের এসব ডিভাইসের ব্যবহার খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যদি এটি না থাকে তাহলে এরকম কিছু সফটওয়্যারের মাধ্যমেও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

পেডিয়াট্রিক্স আমেরিকান একাডেমী ও কানাডিয়ান পেডিয়াট্রিক সোসাইটির পেডিয়াট্রিক অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এবং 'Virtual Child'-এর লেখক Cris Rowan, বিশিষ্ট স্নায়ুবিজ্ঞানী এবং 'Hooked on Games'-এর লেখক Dr. Andrew Doan ও 'Restart Internet Addiction Recovery Program'-এর পরিচালক এবং 'Video Games and Your Kids'-এর লেখক Dr. Hilarie Cash সব শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য একটি তালিকা তৈরি করেন। তাদের মতামতরে ভত্তিতে ০ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদি ব্যবহারের একটি তালিকা দেয়া হলঃ

বয়সসীমা

সময়সীমা

নন-ভায়লেন্ট

টিভি প্রোগ্রাম

মোবাইল, ট্যাব ডিভাইস

নন ভায়লেন্ট(অহিংস) ভিডিও গেমস

ভায়লেন্ট(সহিংস )  গেমস

অনলাইন ভায়লেন্ট ভিডিও গেমস অথবা পর্নোগ্রাফি

 

০-২ বছর

×

×

×

×

×

৩-৫ বছর

১ ঘণ্টা/দিন

টিক চিহ্ন

×

×

×

×

৬-১২ বছর

২ ঘণ্টা/দিন

টিক চিহ্ন

×

×

×

×

১৩-১৮ বছর

২ ঘণ্টা/দিন

টিক চিহ্ন

টিক চিহ্ন

৩০ মিনিটের বেশি নয়

৩০ মিনিটের বেশি নয়

×

আধুনিক যুগে শিশুকে কম্পিউটার, মোবাইল বা ট্যাব থেকে একেবারেই দূরে রাখা যাবে না, উচিতও নয়। বরং শিশুকে ইন্টারনেট জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।  সর্বোপরি সব ব্যাপারে মা-বাবাকে শিশুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী এবং যত্নশীল হতে হবে।
 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন