সন্তানকে ‘সুপারম্যান’ বানাতে চান!

বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। ‘Survival of the fittest’- ডারউইনের এই তত্ত্বকে অভিভাবকেরা বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন। প্রতিযোগিতার এই যুগে সব বাবা-মাই চান তার সন্তান যেন সবার আগে থাকে। সকলের চেয়ে সে যেন একধাপ এগিয়ে থাকে।

শুধু পড়াশুনা নয়, তারা চান তাদের সন্তান সব দিক থেকে যেন অলরাউন্ডার হয়। সন্তানকে তারা বানাতে চান অতিমানব ‘সুপারম্যান’! কিন্তু এই চাওয়া পূরণ করার জন্য একটি শিশুর উপর কতটা চাপ পড়ে তা কী কখনো আমরা ভেবে দেখেছি?

একটা সময় ছিল যখন শুধু পড়াশুনাকেই খুব বেশি প্রাধান্য দেওয়া হত। শুধু রেজাল্ট ভালো হলেই অভিভাবক সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। জীবনযুদ্ধের যোগ্য সৈনিক হিসেবে তাকে গড়ার জন্য ছোটেবলা থেকেই শেখােনা হচ্ছে গান, নাচ, ছবি অাঁকাসহ শেখানোর মতো সবকিছু।

শুধু ভবিষ্যতের চিন্তাতেই নয় এই শেখানোর পেছনে রয়েছে বাবা-মায়ের শৈশবে না শিখতে পারার ইচ্ছে পূরণের গল্পও। সবই ঠিক আছে শুধু ঠিক নেই যাকে শেখানো হচ্ছে তার মনের খবর। কারন এই শেখা না শেখার সিদ্ধান্তে তার মতামতের কোন মূল্য নেই। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছেরও ধার ধারে না কেউ। আর মধুর শৈশব সেতো ফালতু জিনিস।

গান-নাচ কে না ভালবাসে? অনেক বাবা-মা আছেন যাদের গান-নাচ শেখার অনেক ইচ্ছা ছিল ছোটবেলায় কিন্তু যে কোন কারনে তাদের সেই শখ পূরণ হয়নি। তারা তাদের সন্তানকে দিয়ে সেই শখ পূরণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কখনো জানতে চান না শিল্পকলার এই অংশটি তার বাচ্চার ভালো লাগে কি না?

বর্তমান যুগ বিতর্কের যুগ, যে যত ভালো যুক্তিতর্ক করতে পারে সে ততো স্মার্ট। এই চিন্তায় অনেক অভিভাবক সন্তানকে বিতার্কিক হবার কলাকৌশল শেখান! এছাড়াও নিজের প্রতিরক্ষা আর শরীর ফিট রাখার জন্য জুডো, কারাটে, মার্শাল আর্টস শেখাচ্ছেন। হয়তো খোঁজ নিলে জানা যাবে, যে শিশুরা এগুলো শিখছে তাদের অনেকেরই আগ্রহ ক্রিকেট বা টেনিসে। কিন্তু বাবা-মার রক্তচক্ষুর ভয়ে বাধ্য হয়েই এগুলো শিখছে সে।

খেলাধুলায়ও এগিয়ে থাকতে হবে তাই ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল এগুলোও শেখানো হচ্ছে বাচ্চাকে। অথচ বাচ্চার মন পড়ে রয়েছে ড্রয়িংবুকে বা গানের খাতায়। অথবা কারো মন চায় অভিনয় শিখতে। মুখ ফুটে মাকে হয়তো সে তার ইচ্ছের কথা জানিয়েছে কিন্ত মা ধমকের সুরে বুঝিয়েছেন অন্য কিছু।

কোন কোন অভিভাবক চান তাদের সন্তান যেন সবকিছুতেই পারদর্শী হয়। এই চাওয়াটা একেবারে নতুন কিছু না, কিন্তু এই চাওয়া পূরণের জন্য তার সন্তানকে যে চাপ বহন করতে হচ্ছে তা তার উপযােগী কি না, তা তারা ভেবে দেখেন না । অভিভাবকের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে শিশুটি যে তার শৈশব হারিয়ে ফেলছে, এই বিষয়টি তাদের মাথায় খেলে না। 

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীন ইসলাম চ্যাম্পস টোয়েন্টিওয়ানকে জানান, ‘একজন বাচ্চাকে অবশ্যই সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে তার আগে জানতে হবে কোন জিনিসটি তার ভালো লাগে, কোনটি খারাপ লাগে। তার গান গাইতে ভালো লাগলে অবশ্যই তাকে তা করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু কখনোই তার ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বাবা-মাকে সুযোগ দিতে হবে এবং সন্তানকে সব ধরনের সুবিধা তাদের সাধ্যমত প্রদান করতে হবে।

বে বাচ্চার যদি এসব করতে ভালো না লাগে তাহলে তাকে চাপ দেওয়া যাবে না। তাদের বুঝতে হবে, পড়াশুনার কারনে বাচ্চারা এমনিতে অনেক চাপের মধ্যে থাকে। এর ওপর আলাদা চাপ সৃষ্টি হলে সন্তান বিগড়ে দিতে পারে। অতিরিক্ত চাপের ফলে বাচ্চাটির মধ্যে যদি কোন সুপ্ত প্রতিভা থেকেও থাকে, তা নষ্ট হয়ে যায়।

এছাড়া বাড়তি চাপ দেয়ার কারণে বাবা-মার সাথে সম্পর্কও ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। কিছু কিছু বাচ্চা থাকে যারা এমনিতেই অলরাউন্ডার। তারা সবকিছুতেই বিজয়ী হয়ে বাবা-মা, শিক্ষক সবাইকে খুশি রাখতে পারে। কিন্তু সব বাচ্চাকেই বিজয়ী হতে হবে এমন কোন কথা নেই, এই ব্যাপারটি বাবা-মাকে বুঝতে হবে।’

প্রত্যেকটা বাচ্চাই অন্য একটি বাচ্চার থেকে আলাদা। শিশুর মাঝে কোন প্রতিভা থাকলে তাকে একটু নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করলেই তা প্রকাশ পায়। উপযুক্ত চর্চার মাধ্যমে সেই প্রতিভাকে আরও বিকশিত করা সম্ভব। ছোটবেলা থেকেই দেখা যায়, বাবা মা বাচ্চাদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন এক্সট্রা-কারিকুলার একটিভিটিতে অংশ নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন।

বাচ্চাটিও তখন সেগুলো বাধ্য হয়ে শিখতে থাকে। কিন্তু একটা সময়ে দেখা যায় সে সবই শিখছে কিন্তু কোনটায় পারদর্শী হতে পারছে না। এতে ধীরে ধীরে তার মধ্যে একধরণের হীনমন্যতা তৈরি হয়।

তার কাছে তখন মনে হতে থাকে, সে এত কষ্ট করছে কিন্তু কোনটাতেই সে বিজয়ী হতে পারছে না। তার আত্মবিশ্বাসও কমতে শুরু করে তখন। অভিভাবকদের এটা বুঝতে হবে, ‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস’ না হওয়ার চেয়ে ‘মাস্টার অফ ওয়ান ট্রেড’ হওয়াটা অনেক বেশি ভালো।

সব বাচ্চাই এক না, সবার মস্তিষ্কের এর ধারণক্ষমতাও এক নয়। অভিভাবকের কাজ হচ্ছে সন্তানের সেই প্রতিভাটিকে খুজে বের করা। সেটাকে বিকশিত করা। দুর্বলতাকে সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টার চেয়ে প্রতিভার বিকাশে গুরুত্বআরোপ করতে হবে।

বাবা-মা তাদের সন্তানের কাছে অনেক কিছুই প্রত্যাশা করেন, কিন্তু সব প্রত্যাশা পূরণ করাটা সন্তানের জন্য মাঝে মাঝে অনেক বেশি কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

বাবা-মাকে বুঝতে হবে তার সন্তানের সীমাবদ্ধতা। মনে রাখবেন, আপনার গগনচুম্বী প্রত্যাশা সন্তানকে আপনার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিতে পারে। সর্বেসর্বা হয়ে উঠার ক্রমাগত চাপ তাকে ধ্বংসের পথেও ঠেলে দিতে পারে।

অনেকক্ষেত্রে অভিভাবকদের অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপের কারণে টিএনএজারদের মধ্যে এক ধরণের রাগ বাসা বাঁধতে শুরু করে। যারা বহির্মুখী তারা হয়ত চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজের মনোভাবটা বাবা-মায়ের কাছে প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু যারা অন্তর্মুখী তারা কারো সাথে কিছু শেয়ার করতে না পেরে নিজেদের মধ্যেই ‌ব্যাপারগুলো গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে নিজেকে ঠেলতে থাকে।

সবকিছুতে ১০০ তে ১০০ পাওয়া অলরাউন্ডার বাচ্চারাই যে শুধু জীবনযুদ্ধে জয়ী হয় এই ধারণা থেকে আজই সরে আসুন। সঠিক শিক্ষা আর অনুকূল পরিবেশ পেলে ক্লাসের শেষ বেঞ্চের শিক্ষার্থীও যে সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে তা কিন্তু বাস্তব সত্য।

তাই অতিমানব নয় সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করুন।

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন