সবার চেহারা যখন অচেনা লাগে!

কেমন হত যদি এই পৃথিবীতে সবাই অচেনা হয়ে যেতো? রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, কেউ কাউকে চিনি না, ঘরে ফিরে আসলাম, চেনা মানুষ কেউ নেই, চিন্তাটা বেশ ভয়ানক, তাই না? কিন্তু এমনটাই ঘটে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে। স্মৃতিভ্রম বা আলঝেইমার্স বেশ সাধারণ একটি বার্ধক্যজনিত রোগ। এর ফলে বয়সের কারণে মানুষের স্মৃতি ধীরে ধীরে লোপ পায়, এবং মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখা যায় যে নিজের চেহারাটাই আর চেনা যাচ্ছে না, সেটা কেমন হয়! শুধু নিজের চেহারা নয়, আশেপাশের সবার কথা মনে আছে ঠিকই, কিন্তু তাঁদের চেহারাটা ঠিক চেনা যাচ্ছে না, শুনতে বেশ অদ্ভুত মনে হলেও এমন একটি রোগ রয়েছে যে রোগে মানুষ চেহারা ভুলে যায়, এর নাম Prosopagnosia। আলঝেইমার্সের সাথে এর তেমন মিল নেই, কারণ আলঝেইমার্স রোগে মানুষের পুরো স্মৃতি লোপ পায়, কিন্তু এই রোগে স্মৃতি মনে থাকে ঠিকই, শুধু চেহারাটা আর মনে থাকে না।

মানুষের মস্তিস্কের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে তা আমরা জানি, একেক ভাগের কাজ একেক রকম। Fusiform Gyrus নামে মস্তিস্কের একটি অংশ মানুষের চেহারা মনে রাখার এবং চিনতে পারার কাজ করে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, Prosopagnosia রোগে মস্তিস্কের এই Fusiform Gyrus অংশটি আক্রান্ত হয়। Prosopagnosia রোগটি দুই সময়ে হতে পারে, একটি জন্মগত, এবং অপরটি অর্জিত। প্রথমটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনের কোন অংশেই Fusiform Gyrus পুরোপুরিভাবে কাজ করতে পারে না, এর ফলে সবসময়েই তাঁদের চেহারা চিনতে কষ্ট হয়, অর্থাৎ তাঁরা জন্ম থেকেই এই রোগ নিয়ে বড় হন। অপরটি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যেকোনো সময়ে হয়ে থাকে।

অনেক গবেষকদের গবেষণার পরেও আজ পর্যন্ত Prosopagnosia রোগের সঠিক কারণ ও প্রতিকার বের করা যায়নি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিছু বিশেষ পদ্ধতিতে মানুষের চেহারা মনে রাখা শেখানো হয়। এই পদ্ধতিতে চেহারা ছাড়া মানুষের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে মনে রাখা শেখানো হয়, যেমন- কাপড়-চোপড়ের ধরণ, চুলের রঙ, গায়ের রঙ, দৈহিক আকৃতি, কণ্ঠস্বর ইত্যাদি। যেহেতু এই রোগে আক্রান্তরা শুধুমাত্র চেহারা ভুলে যান, অন্য কিছু না, তাই চেহারা ছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে তাঁদের অন্য মানুষের কথা মনে রাখতে শেখানো হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর দিকে হিউলিংস জ্যাকসন এবং চারকট নামক দুজন ব্যক্তির সংকলিত কিছু মেডিক্যাল কেস-এ সর্বপ্রথম Prosopagnosia-র অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে জোয়াকিম বোডেমার নামক একজন জার্মান নিউরোলজিস্ট Prosopagnosia নামটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। তিনি এই রোগের তিনটি ঘটনা বর্ণনা করেন যার মধ্যে একজন যুবকের ঘটনা ছিল যার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। মাথায় বুলেটের আঘাতের ফলে ঐ যুবকের মস্তিস্ক আক্রান্ত হয় এবং তার এই রোগ দেখা দেয়। ১৯৮৫ সালের দিকে একজন বিখ্যাত ডাক্তার অলিভার স্যাকস একটি বই লেখেন, যার নাম ছিল “The Man Who Mistook His Wife for a Hat”, এই বইতে তিনি Prosopagnosia সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত বর্ণনা লেখেন। মজার ব্যাপার হল, এই ডাক্তারের নিজেরই Prosopagnosia রোগ ছিল, কিন্তু তিনি নিজে কোনদিন এটা বুঝতে পারেন নি। এই বইতে তিনি যে ব্যক্তির কথা লেখেন যে কিনা তার স্ত্রীকে চিনতে পারত না, এটা ছিলেন তিনি নিজে। তিনি তাঁর স্ত্রীকে তাঁর কণ্ঠস্বর দিয়ে চিনতেন। তাঁর বড় ভাইকে তিনি চিনতে পারতেন চওড়া চোয়াল এবং বড় দাঁত দেখে।

অনেক বাচ্চারাই দেখা যায় যে মানুষের সাথে সহজে মিশতে বা কথা বলতে পছন্দ করে না। আবার অনেক বাচ্চা পরিচিত মানুষের সাথেও অপরিচিতের মত আচরণ করে। বাবা-মা ভেবে নেন যে তাঁদের বাচ্চা লাজুক বলে এমনটা ঘটছে। কিন্তু সত্যিই বাচ্চা লাজুক বলে এমনটা ঘটছে নাকি বাচ্চা সত্যিই কাউকে চিনতে পারছে না সেটা পরীক্ষা করে দেখা একান্ত জরুরী।

বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে ডাক্তার অলিভার স্যাকস ছাড়াও আরও অনেকে Prosopagnosia রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- হিউবার্ট ড্রাইফাস (আমেরিকান দার্শনিক), থিয়েরে লারমিট (ফ্রেঞ্চ অভিনেতা), মেরি অ্যান সেইগার্ট (বিখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক), স্টিভ ওঝিয়েক (অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা), ভিক্টোরিয়া (সুইডেনের রাজকুমারী)।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন