ইস্টার সানডে কী?

সারা বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হল ইস্টার সানডে। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টকে বিপথগামী ইহুদি শাসকগোষ্ঠী তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন শাসন ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছিল।

মৃত্যুর তৃতীয় দিবস রবিবারে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন যিশুখ্রিস্ট। পুনরুত্থানের ওই রবিবারটি ইস্টার সানডে হিসেবে পরিচিত। চল্লিশ দিনের রোজা পালন শেষে এ ইস্টার সানডে বিশ্বের সব খ্রিস্টভক্তের জীবনে বয়ে আনে নির্মল আনন্দ ও শান্তি।

ইস্টার বা ইস্টার সানডে চল্লিশ দিনব্যাপী উপবাস, প্রার্থনা এবং অণুশোচনার মাধ্যমে পালন করা হয়। চল্লিশ দিনব্যাপী উপবাসের শেষ সপ্তাহকে পুণ্য সপ্তাহ বলা হয়। এটা ইস্টার ট্রিডুমের দিন, মন্ডি থার্সডেসহ, মন্ডি সূত্রপাত এবং শেষ ভোজ, যা অতি পরিচিত গুড ফ্রাইডে হিসেবে এবং যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণ ও মৃত্যুর সূত্রপাত সমন্বয়ে গঠিত।

যিশুর বিচারের শাস্ত্রীয় বিবরণীগুলো থেকে অনুমান করা হয় যে তাঁকে সম্ভবত শুক্রবারে ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছিল। দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মতে গুড ফ্রাইডের বছরটি হল ৩৩ খ্রিস্টাব্দ। আইজ্যাক নিউটন বাইবেলীয় ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং অমাবস্যার তিথি বিচার করে গুড ফ্রাইডের যে প্রকৃত সালটি নিরুপণ করেছেন, সেটি হল ৩৪ খ্রিস্টাব্দ। ক্রুসিফিকেশন ডার্কনেস অ্যান্ড একলিপস পদ্ধতি নামে একটি তৃতীয় পদ্ধতিতে হিসেব করে গুড ফ্রাইডের তারিখ নিরুপণ করা হয়েছে ৩ এপ্রিল, ৩৩ খ্রিস্টাব্দ।

বাইবেলের বর্ণনা
সুসমাচার অনুযায়ী, যিশুর শিষ্য যিহুদা ইসকারিয়োতের সহায়তায় মন্দিরের রক্ষীদল গেৎশিমানি উদ্যানে যিশুকে গ্রেফতার করে। যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পুরস্কারস্বরূপ যিহুদাকে ৩০টি রৌপ্যমুদ্রা দেয়া হয়। যিহুদা রক্ষীদলকে বলে রেখেছিলেন যে তিনি যাঁকে চুম্বন করবেন তিনিই হবেন যিশু। যিশুকে হাননের প্রাসাদে নিয়ে আসা হল। হানন ছিলেন সেই বছরের জন্য নিযুক্ত প্রধান পুরোহিত কায়াফারের শ্বশুর। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে বিশেষ ফল না হওয়ায় তাঁকে প্রধান পুরোহিত কায়াফারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সানহেড্রিয়ান (প্রাচীন ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষ) একত্রিত হয়।

যিশুর বিচারসভায় বিভিন্ন সাক্ষী পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যপ্রদান করেছিল। যিশু সেই প্রসঙ্গে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি। অবশেষে প্রধান পুরোহিত নিজে উঠে যিশুকে শপথপূর্বক নিজ বক্তব্য জানাবার আদেশ দিলেন। তিনি বললেন, “জীবনময় ঈশ্বরের দোহাই, আমাদের বল, তুমিই কি ঈশ্বরের পুত্র সেই খ্রিষ্ট?” যিশু উত্তর দিলেন, “আপনি নিজেই তা বললেন। তাছাড়া আমি আপনাদের বলেছি, এখন থেকে আপনারা দেখবেন মানবপুত্র সর্বশক্তিমানের দক্ষিণে উপবিষ্ট। আবার মেঘবাহনেও তাঁকে নেমে আসতে দেখবেন”। প্রধান পুরোহিত এই কথার জন্য যিশুকে ঈশ্বরনিন্দার দায়ে অভিযুক্ত করলেন। যিশুর সানহেড্রিয়ন বিচার শেষ হল তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মাধ্যমে। এদিকে বিচার চলাকালীন অঙ্গনে অপেক্ষমাণ পিতর বিচার দেখতে আসা জনগণের নিকট তাঁর সঙ্গে যিশুর সম্পর্কের কথা তিনবার অস্বীকার করলেন। যিশু অবশ্য আগে থেকেই জানতেন যে পিতর তাঁকে তিনবার অস্বীকার করবেন।

পরদিন সকালে সকল সভাসদগণ যিশুকে রোমান রাজ্যপাল পন্টিয়াস পিলাতের নিকট নিয়ে গেল। তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ, সিজারকে রাজস্বদানে বাধা ও নিজেকে রাজা ঘোষণা করার অভিযোগ আনা হল। পিলাত ইহুদি সমাজপতিদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী যিশুর বিচার ও শাস্তিদানের অনুমতি দিলেন। কিন্তু ইহুদি সমাজপতিরা জানালেন রোমান আইন অনুযায়ী তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুমতি নেই।

পিলাত নিজে যিশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন ও ইহুদি বিচারকদের জানালেন যে তিনি যিশুকে শাস্তিদানের কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। যিশু গালিলের লোক জেনে তিনি গালিলের শাসক রাজা হেরোদের উপর যিশুর বিচারের ভার ছেড়ে দিলেন। হেরোদ তারণোৎসব ভোজসভা উপলক্ষে সেই সময় জেরুজালেমেই ছিলেন। হেরোদ যিশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো উত্তর পেলেন না। তিনি পুনরায় যিশুকে পাঠিয়ে দিলেন পিলাতের কাছে। পিলাত সমাজপতিদের জানালেন যে তিনি বা হেরোদ কেউই যিশুকে দোষী মনে করছেন না। শেষে পিলাত সমস্যা সমাধানের জন্য যিশুকে শুধুমাত্র চাবুক মেরে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব রাখলেন।

তারণোৎসব ভোজসভার রীতি অনুযায়ী এই দিন ইহুদিদের অনুরোধক্রমে রোমানরা একজন বন্দীকে ছেড়ে দিতেন। পিলাত জনসাধারণকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তারা কার মুক্তি চাইছে। প্রধান পুরোহিতের অঙ্গুলি হেলনে জনগণ খুনি বারাব্বাসের মুক্তি চাইল। পিলাত যিশুকে নিয়ে কি করা উচিত সেই ব্যাপারে সকলের মতামত চাইলে সকলেই এক বাক্যে বলল ‘ওকে ক্রুসবিদ্ধ করুন’। পিলাতের স্ত্রী পূর্বরাত্রে যিশুকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তিনি পিলাতকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, “এই ধার্মিক মানুষটির ক্ষতি করো না”।

পিলাত যিশুকে কশাঘাত করে তাঁকে মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে আবার সর্বসমক্ষে নিয়ে এলেন। প্রধান পুরোহিত তখন যিশুর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদ্রোহিতার নতুন অভিযোগটি আনলেন। ভয় পেয়ে পিলাত পুনরায় যিশুকে জিজ্ঞাসাবাস করার জন্য ভিতরে নিয়ে গেলেন।

জনতার সম্মুখে এসে পিলাত আবার যিশুকে নিরপরাধ ঘোষণা করলেন। তিনি জলে হাত ধুয়ে জানিয়ে দিলেন, যিশুর বিচারে আর তিনি অংশ নেবেন না। তবে সম্ভাব্য দাঙ্গা রোখার জন্য এবং নিজের চাকরি রাখতে পিলাত যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। “নাজারেথের যিশু, ইহুদিদের রাজা” লেখা একটি ক্রুস যিশু বয়ে নিয়ে চললেন গলগথা নামক স্থানে। তাঁকে ক্রুস বহনে সাহায্য করেছিলেন সাইরিনের সিমন। গলগাথায় অপর দুই অপরাধীর সঙ্গে তাঁকে ক্রুসবিদ্ধ করা হল।

ছয় ঘণ্টা যিশু ক্রুসে যন্ত্রণাভোগ করেন। শেষ তিন ঘণ্টায় (দুপুর তিনটে থেকে) অন্ধকারে সমগ্র অঞ্চলটি ঢেকে যায়। চিৎকার করে যিশু প্রাণত্যাগ করেন। ভূমিকম্প হয়, সমাধিপ্রস্তরগুলো ভেঙে যায় এবং প্রধান মন্দিরের পর্দা উপর থেকে নিচ অবধি ছিঁড়ে যায়। যে সেঞ্চুরিয়ন ক্রুসবিদ্ধকরণের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, “ইনি সত্য সত্যই ঈশ্বরপুত্র ছিলেন”।

সানহেড্রিয়ানের সদস্য তথা যিশুর গোপন অনুগামী আরিমাথিয়ার যোসেফ যিশুর বিচারে সম্মতি দেননি। তিনি পিলাতের নিকট যিশুর দেহ চেয়ে নেন। নিকদিম নামে যিশুর আর এক গোপন অনুগামী তথা সানহেড্রিয়ানের সদস্য একশো পাউন্ড ওজনের মশলার মিশ্রণ নিয়ে যিশুর দেহ কাপড়ে মুড়তে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। যিশুর মৃত্যু হয়েছে কিনা তা জানতে পিলাত সেঞ্চুরিয়নকে আদেশ দিলেন। এক সৈনিক যিশুর দেহে বর্শার আঘাত করাতে ক্ষতমুখ দিয়ে রক্ত ও জল নির্গত হল। সেঞ্চুরিয়ন পিলাতকে যিশুর মৃত্যুসংবাদ দিলেন।

আরিমাথিয়ার যোসেফ যিশুর দেহ পরিস্কার ক্ষৌমবস্ত্রে মুড়ে ক্রুসবিদ্ধকরণক্ষেত্রের অদূরে একটি বাগানে তাঁর নিজের জন্য নির্মাণ করা প্রস্তরখোদিত সমাধিমন্দিরে রেখে দিলেন। নিকদিম এলেন সোয়া মণ গন্ধরস মেশানো অগুরু নিয়ে। ইহুদি সৎকার প্রথা অনুযায়ী সেগুলো রেখে দিলেন আচ্ছাদন বস্ত্রে যিশুর দেহের সঙ্গে। একটি বড় পাথর দিয়ে তারা সমাধির মুখ রুদ্ধ করে দিলেন। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সাব্বাথ শুরু হয়ে যাবে বলে তারা তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলেন। তৃতীয় দিন, রবিবার, যিশু পুনরুজ্জীবিত হলেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন