আচ্ছা কখনো কি টেলিফোন কিংবা ইন্টারনেটের তারটাকে কেটে দেখেছ কি আছে এর মধ্যে। দেখবে বিশুদ্ধ কাঁচের তার, যা কিনা মানুষের চুলের মতো চিকন। কি এই জিনিসটা? যা কিনা আলোর গতিতে ডাটা একস্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিতে সক্ষম।
এই চিকন তারটির নাম অপটিক্যাল ফাইবার যা এক ধরণের আলোর পরিবাহক। যার কাজটা ঠিক ডাকপিয়নের মতোই, ডাকপিয়ন যেমন ডাকঘরে আসা চিঠি ঘরে ঘরে বিলি করে দেয় তেমনি অপটিক্যাল ফাইবার আলোর প্রতিফলনের মাধ্যমে কোনো একটি প্রতিবিম্ব অথবা তথ্য একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রেরণ করে থাকে।
ডিজিটাল বাংলাদেশে বর্তমানে টেলিফোন ও ইন্টারনেটের ছড়াছড়িতে ফাইবার অপটিক বহুল আলোচিত একটি শব্দ। শুধু আলোর গতিতে ডাটা পোঁছে দেওয়ার জন্যই এর এতো নাম ডাক না বরং এই কাজের পাশাপাশি মেডিক্যাল টেকনোলজি ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অপটিক ফাইবার টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে।
আচ্ছা অপটিক ফাইবারের কাজ তো জানা হল কিন্তু কে বা কোন বিজ্ঞানী কিভাবে এর আগমন ঘটালো তা জানা এখনও জানা বাকি।
ফরাসি বিজ্ঞানী Claude Chappe কর্তৃক ১৭৯০ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় অপটিক্যাল টেলিগ্রাফ। এই পদ্ধতিতে মনুষ্য অপারেটর এক টাওয়ার থেকে অন্য টাওয়ারে বার্তা পাঠাতো ঠিকই কিন্তু ইলেক্ট্রিক টেলিগ্রাফ আসার কারণে এর অবসর গ্রহণ করতে হল। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ১৮৮০ সালে অপটিক্যাল টেলিফোন সিস্টেম আবিস্কার করেন যা ফটোফোন হিসেবে পরিচিতি ছিল। কিন্তু আবিষ্কারের সাথে একটা বিরাট ত্রুটি রেখেছিলেন তিনি আর তা হল তিনি বাতাসে আলোকসিগন্যাল পাঠানোর চিন্তাভাবনা করেছিলেন কিন্তু আবহাওয়া আলোকে যথাযথভাবে ট্রান্সমিট করতে পারতো না।
তবে বর্তমানে এই আলোর পরিবাহকের আবিষ্কারক সুইস পদার্থবিদ Daniel Collodonও ফরাসি পদার্থবিদ Jacones Babinet তারা ১৯৮৯ সালে ফাইবারে যে আলোর পূর্ণ আভ্যন্তরীণ প্রতিফলন হয় তা আবিস্কার করেন। তাদের এই পথ অনুসরণ করে ১৯২০ সালে Henrich Lamm এবং Munich নামের এই দুই ছাত্র টেলিভিশনের ইমেজ বা ছবি স্বচ্ছ কাঁচদণ্ডের মধ্য দিয়ে পাঠাতে সমর্থ হন। কিন্তু তাদের এই আবিষ্কারও ছিল ব্যর্থ কারণ তাদের আবিষ্কৃত ইমেজ কোয়ালিটি খুব একটা ভাল ছিল না। তাদের ট্রান্সমিশন ছিল আনক্লাডিং তাই বেশিরভাগ আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো ফলে সিগন্যাল দূর্বল হতো। যাই হোক অবশেষে আমেরিকান পদার্থবিদ Brian O'Brien সর্বপ্রথম ক্লাডিং অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহারে সমর্থ হন।
অনেকগুলো ফাইবার অপটিক তন্তু নিয়ে অপটিক্যাল ক্যাবলস গঠিত হয়। প্রতিটি single অপটিক্যাল ফাইবার ৩ টি অংশ নিয়ে তৈরি। যেমনঃ
১- কোর।
২- ক্ল্যাডিংঃ ক্ল্যাডিং হচ্ছে আলোক প্রতিফলনকারী পদার্থ যা মাঝখানের কোরের কাঁচ তন্তুর সব আলোই প্রতিফলিত করে। একেকটি অপটিক্যাল ক্যাবলসে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ফাইবার অপটিক থাকে।
৩- বাফার কোটিংঃ এটি ফাইবারের আবরণকে ক্যাবলকে প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে।
আবার অপটিক্যাল ফাইবার দুই প্রকার,
১- সিঙ্গেল মোড ফাইবার
২- মাল্টি মোড ফাইবার।
সিঙ্গেল মোড ফাইবার কোরের ব্যাস ৯ মাইক্রন। এর কাজ হচ্ছে ইনফ্রারেড লেসার লাইট ট্রান্সমিট করা। আর মাল্টি মোড ফাইবার কোরের ব্যাস ৬২.৫ মাইক্রন এবং এটির কাজ ইনফ্রারেড লাইট ট্রান্সমিট করা।
সাধারণত টান, তাপমাত্রা, চাপ ও আরো অনেক উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যম Sensor হিসেবে অপটিক্যাল ফাইবারকে ব্যবহার করা যায়। কারণ এটি আকৃতিতে ছোট এবং কম বিদ্যুৎ খরচ করে তাই তড়িৎ সেন্সরের থেকে অপটিক্যাল ফাইবারের সুবিধা বেশি।
তবে আমাদের দেশের জন্য দুঃখের সংবাদ এই যে, বাংলাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার উৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা নেই যেখানে আমাদের টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে এখানে অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যবহার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন ধরা যাক বাংলাদেশ রেলওয়ের কথা তাদের নিজস্ব টেলিযোগাযোগের প্রয়োজনে অপটিক্যাল ফাইবারের নেটওয়ার্ক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আবার বিটিসিএল (Bangladesh Telecommunication Company Limited) সম্প্রতি কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরের টেলিফোন নেটওয়ার্কের অংশবিশেষে অপটিক্যাল ফাইবার ব্যবহার প্রসারিত করেছে। এছাড়া লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক বা ল্যান (LAN) গড়ে তোলার জন্যও বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ানো হচ্ছে। যেমন সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য অপটিক্যাল ফাইবারের একটি ল্যান কাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। টেলিফোন ব্যবস্থায় একটি একক ফাইবার ক্যাবল শত শত বা এমনকি হাজার হাজার কপার সার্কিটকে প্রতিস্থাপন করতে পারলে প্রতি ভয়েস চ্যানেলে অনেক কম খরচে অধিক নির্ভরযোগ্যভাবে তথ্য প্রেরণ করা সম্ভব এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় খুবই সীমিত।
বেশ কয়েক বছর আগেই SEA-ME-WE 4 নামের একটি অপটিক্যাল ফাইবার সাবমেরিন কমিউনিকেশন ক্যাবল বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই ক্যাবল ১৬টি পয়েন্টে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের অনেকগুলো দেশের সাথে যুক্ত হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল বঙ্গোপসাগরের তলা দিয়ে এসে কক্সবাজার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামকে সরাসরি সিঙ্গাপুরের সাথে সংযুক্ত করেছে। এ ক্যাবলের ব্যবহারের কারণে ইন্টারনেট ব্রাউজিং-এর গতি প্রচন্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক টেলিফোন কলগুলির মূল্যও হ্রাস পেয়েছে। তবে অপটিক্যাল ফাইবারের উপকারিতার কথা বিবেচনা করে বর্তমানে SEA-ME-WE 5 নামে উন্নততর আরেকটি ক্যাবল স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে। ২০১৬ সালের মধ্যে এটি শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়াও ভারত থেকে বেনাপোল দিয়ে একটি অপটিক্যাল ফাইবার (ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টিয়াল ক্যাবল) বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশ থেকেও ক্যাবল ভারতে গিয়েছে।