আমাদের বীরগাথা

ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-
বীরপ্রতীক মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান (পিএসসি) ১৯৫৩ সালের ২৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা এটোমিক এনার্জি কমিশনের চিফ নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট এ এইচ এম হাবিবুল ইসলাম এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ও ইংরেজির প্রফেসর মিসেস শামসুন্নাহার ইসলামের দ্বিতীয় সন্তান ওয়াকার হাসান। তার স্থায়ী নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার শাহারপাড়া গ্রামে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠালগ্নে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর ‘ফার্স্ট এস এস কোর্স’ এর অধীনে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে ওয়াকার হাসান তার সেনাজীবন শুরু করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ওয়াকার হাসান প্রথমে তিন নং সেক্টর এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে ‘জেড ফোর্স’-এর অধীনে ফার্স্ট ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে অংশগ্রহণ করেন।
…………………………………………………………

গৌরীপুর গ্রামে আমরা ডিফেন্স নিলাম ২৫ নভেম্বর ১৯৭১। দুইটা কোম্পানি সামনে ও দুইটা কোম্পানি পেছনে অবস্থান নিলো। সামনে ছিল ব্রাভো ও আলফা কোম্পানি। আর ডেলটা কোম্পানি ছিল পেছনের ডানদিকে। আর পেছনে বামদিকে ছিল চার্লি কোম্পানি। আমরা শত্রুপক্ষের কাছ থেকে সেখানে কোনো আক্রমণ প্রত্যাশা করিনি। ভাবলাম সহজেই কানাইঘাট পার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবো।

রাতের বেলায় আমাদের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জিয়াউদ্দিন আমার ডিফেন্সে আসলেন। এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'How is the defence?'। তারপর বললেন, ‘তোমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। পাকিস্তানিরা হামলাও করতে পারে। You remain very careful.’ আমি বললাম, 'Sir, we are absolutely in  position. পাকিস্তানিরা আসলে ফিরে যেতে পারবে না।’ আমার উত্তরে আশ্বস্ত হয়ে উনি চলে গেলেন।

আমার ডানদিকের প্লাটুনে ছিলেন সুবেদার মুসা। উনার সঙ্গে অয়্যারলেস সেটে কথা বললাম। উনি বললেন, Sir, we are in defence. বামদিকের ১০নং প্লাটুনও ডিফেন্সে। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার মেজর বজলুল গণি পাটোয়ারী কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে ছিলেন। রাত এভাবে কেটে গেলো। ২৬ তারিখ খুব ভোরে হঠাৎ করে ডানদিক থেকে গুলির শব্দ শোনা গেলো।  সেদিন খুব কনকনে শীত। চারদিকে কুয়াশা থাকায় কিছ্ইু বোঝা যাচ্ছিল না।

আমি সঙ্গে সঙ্গে অয়্যারলেস সেটে সুবেদার মুসার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘কী ব্যাপার? এখান দিয়ে তো পাকিস্তানিরা আসার কথা না। গুলির আওয়াজ কোনদিক থেকে আসলো?’ সুবেদার মুসা বললেন, ‘স্যার ওরা আক্রমণ করতে করতে আসছে। আমি দেখছি।’ আমি বললাম, ‘ওকে।’ পাকিস্তানিরা এর মধ্যে ভেতরে ঢুকে একটা সাইড দখল করে নিয়েছে।

তখন সুবেদার মুসা অয়্যারলেস সেটে কোম্পানি কমান্ডার মেজর পাটোয়ারীকে উদ্দেশ্য করে  বলছিলেন, ‘স্যার পাকিস্তানিরা তো আমাদের জায়াগাটা প্রায় দখল করে ফেলেছে।’ মুসা খুব চিল্লাচ্ছিল অয়্যারলেস সেটে। আমি শুনছিলাম। কিন্তু কোম্পানি কমান্ডার প্রত্যুত্তরে কিছু বলছিলেন না। আমি ভাবলাম কোম্পানি কমান্ডার হয়তো কোনো মেসেজ রিসিভ করতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে গিয়েছেন।

আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। সুবেদার মুসাকে অয়্যারলেস সেটে বললাম, ‘আপনার অবস্থাটা কী?’ সুবেদার মুসা বললেন, ‘পাকিস্তানিরা খুব কাছাকাছি, স্যার। আমাকে সারেন্ডার করতে বলছে।’ আমি বললাম, ‘আপনি দশ মিনিট ধরে রাখতে পারবেন?’ মুসা বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার পারবো।’ আমি বললাম, ‘তাহলে আমি আসছি।’ আমার দুইটা মেশিনগান ছিল।

দুইটা মেশিনগান ওখানে লাগিয়ে মেশিনগানম্যানদের আমি বললাম, একদম যতো গোলাবারুদ আছে তা দিয়ে গুলি করো। একজনকে ওখানে রাখবে না। All should be killed. আর সুবেদার মুসাকে বললাম, ‘আপনার কাছে কতোজন সৈনিক আছে?’ তিনি বললেন, ‘স্যার ত্রিশজন।’ 

আমি বললাম, ‘আপনি যে পুকুর পাড়ে আছেন, আপনি পাড় থেকে নিচে চলে যান। যেন আমার গুলি আপনার গায়ে না লাগে। আর পাড়ের দিকে খেয়াল রাখেন। যদি পাঞ্জাবিরা আপনাদের মারতে চায় তাহলে পাড়ে উঠতে হবে। দেখে দেখে আপনি মারবেন তাদের। আর আমি আসছি।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে স্যার।’ আমি আবারো তাকে মাথা না তোলার জন্য সাবধান করলাম।

আমার মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে পাকিস্তানিদের লাশ পড়া শুরু হলো। আমি আমার সৈনিকদের হামাগুড়ি দিয়ে চলতে বললাম কারণ আমাদের গুলি আমাদের নিজের গায়ে লাগতে পারে। এভাবে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে গ্রামে পৌঁছে গেলাম। তখন সকাল হয়ে আসছে। আগেই মেশিনগানম্যানকে বলা ছিল যে প্রথম লোক পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার বন্ধ করে দেবে।

আমরা নিরাপদে গ্রামে পৌঁছানোর পর তারা গুলিবর্ষণ বন্ধ করলো। কিন্তু ঢুকে যাওয়ার পর দেখি বিশ্রি একটা অবস্থা। আমরা খাকি কাপড়, পাঞ্জাবিরাও খাকি কাপড়, ওদেরও চাইনিজ আর্মস, আমাদেরও চাইনিজ আর্মস, ওদের মাথায়ও হেলমেট, আমাদেরও হেলমেট, ওদেরও বুট, আমাদেরও বুট। সবকিছুতেই হুবহু মিল। আর আমার ফার্স্ট বেঙ্গলের সৈনিকরা ছিল পাঞ্জাবিদের মতো লম্বা-চওড়া। তাই কেউ কাউকে পৃথক করে চিনতে পারছিলাম না।

এখন গুলি করলে আমি আমার নিজের লোককেও মেরে ফেলবো। তাই ফায়ার বন্ধ করে দিলাম। ওদেরও একি অবস্থা। তারাও ফায়ার বন্ধ করে দিলো। তখন সঙ্গে সঙ্গে বেয়োনেট লাগিয়ে আমরা প্রস্তুত। এরপর শুরু হলো বেয়োনেটিং, ঘুষি, লাথি, অর্থাৎ ক্লোজ কোয়াটার কমবেট। হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলো। আমার সঙ্গে আমার অয়্যারলেস অপারেটর ছিল। সে ছিল নির্ভীক। আরো দুজন যোদ্ধা ছায়ার মতো আমার পাশে থাকতো।

তারা মনে করতো আমি পাকিস্তানিদের সঙ্গে শক্তিতে পারবো না। সেই হাতাহাতি যুদ্ধের সময় হঠাৎ করে দুজন হাবিলদারের একজন আমি কিছু বুঝার আগেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আমি দেখলাম বেয়োনেট আমার নাকের ওপর দিয়ে গিয়ে আমার অয়্যারলেস অপারেটরের গলায় ঢুকে গেছে। চাপটা আমার ওপরে থাকায় অয়্যারলেস অপারেটরের গলায় কোয়ার্টার ইঞ্চির মতো ঢুকেছে। আমি সেই পাকিস্তানিকে তৎক্ষণাৎ মাথায় গুলি করে হত্যা করলাম।

এই ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ওঠার আগেই বটগাছের ফাঁক থেকে পাকিস্তানি এক মেজর (পরে জেনেছি সে ছিল থার্টিফার্স্ট পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর সারওয়ার) বের হয়ে এসে বিশ্রি ভাষায় আমাকে একটা গালি দিয়ে সাব-মেশিনটাকে ধরে ট্রিগার টিপে ঘুরাচ্ছিল।

সাব-মেশিনগানে একসঙ্গে অনেক গুলি বের হয় বলে দুবারের পর আমরা ম্যাগজিন পরিবর্তন করি। আরেকটা নতুন ম্যাগজিন লাগাই। সেটা ও খেয়াল করেনি। তাই সে যখন ঘুরিয়ে সাব-মেশিনগানটা আমার সোজাসুজি আনছে তখন সেটার গুলি শেষ হয়ে গেছে। সে আর বটগাছের পেছনে ফিরে যাবার সময় পায়নি। সেই সুযোগে আমি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে একেবারে পায়ের থেকে মাথা পর্যন্ত আটাশটা বুলেট পার করে দিলাম।

মেজর সারওয়ার পড়ে গেলো ওখানে। দ্বিতীয়বারের মতো মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে দৈবভাবে বেঁচে গেলাম। সারোয়ারকে বাঁচাতে আরেকজন পাকিস্তানি সৈন্য আসছিল। তার বুকেও লক্ষ্যভেদ করলাম। মেজরের এই অবস্থা দেখে পাকিস্তানি সৈন্যরা দৌড় দিলো। এর মধ্যে তাদের প্রচুর হতাহত হয়েছে। তারা দৌড়ে গ্রামটা ছেড়ে ধানক্ষেতে ঢুকে গেলো। আমরাও ধাওয়া করলাম। আমার এক নায়েককে বললাম, ‘এলএমজি দিয়ে বাস্ট ফায়ার করো একটা।’

বাস্ট ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচটা পাকিস্তানি সেনা পড়ে গেলো। বাকিগুলো দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো, ‘স্যার, খোদা কো ওয়াস্তে মাত মারো।’ থার্টিফার্স্ট পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২৬ জনকে ধরা হলো। আমার সঙ্গে ছিল সুবেদার হাই।

আমি উনাকে বললাম, ‘সুবেদার সাহেব, বহু লাশ দেখা যাচ্ছে এখানে, আমাদের সব লোক কি মরে গেলো নাকি যুদ্ধে?’ তিনি বললেন, ‘স্যার দেখছি, আল্লাহ ভরসা।’ তারপর আমরা খোঁজা শুরু করলাম। আমাদের  লাশ পেলাম ওখানে সাতজনের আর চার-পাঁচজন আহত। গুরুতর আহত একজনকে হেলিকপ্টারে করে পাঠিয়ে দেয়া হলো বেইজ হাসপাতালে। এরপর থার্টিফার্স্ট পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সবগুলো লাশ একসঙ্গে জড়ো করা হলো।

৮৮ জনকে আমরা কবর দিলাম ওখানে। যে ২৬ জনকে জীবন্ত ধরা হয়েছিল তারা মেরে ফেলা হবে এই ভয়ে কাঁপছিল। তাদের বললাম, ‘তোমরা তো আমাদের দেশের নিরস্ত্র লোককে ধরে ধরে গুলি করে মেরেছো। তোমরা কি আমাদের তাই মনে করো নাকি?’

আমি সুবেদারকে তাদের জন্য চা আনতে বললাম। কিন্তু চা দেয়া হলেও তারা ভয়ে খাচ্ছিল না। তাদের ভয় দূর করতে বললাম, ‘দেখো, উই রেসপেক্ট দ্য জেনেভা কনভেনশন। জেনেভা কনভেনশনে আছে যারা নাকি যুদ্ধবন্দী তাদের মারা নিষেধ। আর আমরা যেটা মনে করি, নিরস্ত্র লোককে যে মারে সে বীর নয়।

সুতরাং আমরা তোমাদের মারবো না। চা খাও।’ চা খাবার পর আবার হাত বেঁধে ওদের প্রিজন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। এতো বড় ক্ষমা পেয়ে তাদের চোখে বিস্ময় খেলা করছিল। যদিও আমার সৈনিকরা কিছুটা ক্ষুব্ধ। আমি তাদের বললাম, ‘কোনোদিনও যুদ্ধবন্দীর গায়ে হাত দেবে না। আমাদের জেনেভা কনভেনশনকে শ্রদ্ধা করা উচিত। আমরা যদি সত্যিকার বীর হয়ে থাকি, তাহলে মনে রাখবে বীররা কখনো নিরস্ত্র লোকদের হত্যা করে না।’

সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন