উপসাগর নিয়ে জানা-অজানাঃ পর্ব ১

উপসাগর নামটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত কেননা হাত বাড়ালেই যে বঙ্গোপসাগর যা শুধু প্রতিবছর আমাদেরকেই নয় গোটা বিশ্বের হাজারো মানুষকে বাধ্য করে তার সৌন্দর্যের দেখে মুগ্ধ হবার জন্য। কি এই উপসাগর? তিন দিক স্থল দ্বারা বেষ্টিত একটি জলভাগ। উপসাগরের জল বড়ই শান্ত হয়। ইংরেজিতে ছোটো আকারের উপসাগরকে ইংরেজিতে বলা হয় Bay। বড় বড় উপসাগরকে ইংরেজিতে Gulf বলা হয় এবং খাড়া পাড় বিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতির উপসাগরকে Fjord বলা হয়। নরম শিলা বা মাটি যখন ঢেউয়ের দ্বারা অপসারিত হয় তখন ছোট ছোট উপসাগরগুলি সৃষ্টি হয়। শক্ত শিলাগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয় অনেক দেরিতে। এই কারণে অন্তরীপের সৃষ্টি হয়। উপসাগরগুলিতে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর দেখা মেলে। দেখে নেয়া যাক পারস্য উপসাগর, বঙ্গোপসাগর ও গিনি উপসাগর নিয়ে কিছু তথ্য। 

 পারস্য উপসাগর

Gulf নামে পরিচিত কিন্তু মাঝারি আকৃতির উপসাগর হল পারস্য উপসাগরএই উপসাগরের নাম এত প্রাচীন যে অনেকে ধারণা করেন, পারস্য উপসাগরই মানব সভ্যতার উৎস বা লালনভূমি। এটি দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত এবং ওমান উপসাগরের এর একটি বর্ধিত অংশ এর বর্তমান অবস্থান হচ্ছে ইরান ও আরব উপদ্বীপের মধ্যে। পারস্য উপসাগর বিশ্বের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এ উপসাগর কৌশলগত দিক থেকেও বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় পরাশক্তিগুলো সব সময়ই এ জলপথে তাদের উপস্থিতি জোরদারের প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে।

এ উপসাগরটির সুবিস্তৃত উত্তরাঞ্চলীয় উপকূল ইরানের অংশ। এর পশ্চিমে রয়েছে ইরাক ও কুয়েত, দক্ষিণে রয়েছে সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। পারস্য উপসাগরের মোট আয়তন দুই লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এ উপসাগর লম্বায় ৯০০ কিলোমিটার এবং চওড়ায় প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। ইরান সংলগ্ন পারস্য উপসাগরীয় উপকূলের দৈর্ঘ্য ৮০০ কিলোমিটার। পারস্য উপসাগরের গভীরতা কম এবং সাধারণত তা ৫০ মিটার, আর সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১০০ মিটার।

খার্গ, আবু মুসা, বড় তুন্ব, ছোট তুন্ব, কিশ, কেশম ও লাভান পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ। পারস্য উপসাগরের গুরুত্বের কারণেই এখানকার হরমুজ-প্রণালী বিশ্বের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বা কৌশলগত প্রণালী হিসেবে বিবেচিত হয়। এ প্রণালী লম্বায় ১৫৮ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ৫৬ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। আন্তর্জাতিক নৌ-পরিবহনের সংখ্যার দিক থেকে হরমুজ প্রণালীর স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। প্রতিদিন প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এ প্রণালী দিয়ে। বিশ্বের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলবাহী তেল ট্যাংকারগুলোর শতকরা ৪০ ভাগ যাতায়াত করে এ সাগর দিয়ে।

Persian Gulf
ছবি : সংগৃহীত

মৎস চাষের ক্ষেত্র হিসেবে এটি যেমন পরিচিত তেমনি প্রবাল রীফ এবং মুক্তা সমৃদ্ধ ঝিনুকে এর ঐশ্বর্যের জন্য পারস্য উপসাগর বিখ্যাত । কিন্তু বর্তমানে এর প্রতিবেশ ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে । তেলবাহী জাহাজের নিয়মিত চলাচলে প্রায়শঃই তেল নির্গত হয়ে এর জলরাশিকে বিষাক্ত করে তুলছে।

এছাড়া, ১৯৮০-১৯৮৮ সালে সংঘটিত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় পারস্য উপসাগর দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। এক দেশ অন্য দেশের তেলবাহী ট্যাংকার আক্রমণ করেছিল এই পারস্য উপসাগরে।

বঙ্গোপসাগর (Bay of Bengal)

ইংরেজিতে  Bay হিসাবে যে সকল উপসাগরকে বুঝানো হয়, বঙ্গোপসাগর হলো তাদের ভিতর সবচেয়ে বড়। বঙ্গোপসাগর (Bay of Bengal)  ভারত মহাসাগরের উত্তরের সম্প্রসারিত বাহু। উপসাগরের পশ্চিমে ভারত ও শ্রীলংকার পূর্ব উপকূল, উত্তরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীপ্রণালী সৃষ্ট বদ্বীপ এবং পূর্বে মায়ানমার উপদ্বীপ থেকে আন্দামান-নিকোবর শৈলশিরা (Ridge) পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগ দ্বারা বঙ্গোপসাগর তিনদিকে আবদ্ধ। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ সীমা শ্রীলংকার দক্ষিণে দন্দ্রা চূড়া থেকে সুমাত্রার উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। সর্বমোট প্রায় ২২ লক্ষ বর্গ কিমি আয়তনের বিশাল এলাকা জুড়ে বঙ্গোপসাগর বিস্তৃত। এর গড় গভীরতা প্রায় ২,৬০০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৫,২৫৮ মিটার। বঙ্গোপসাগরের সর্বউত্তর প্রান্তে বাংলাদেশ অবস্থিত।

Sunrise over Bay of Bengal
ছবি : সংগৃহীত

প্রাচীন মানচিত্রে এই উপসাগরকে গাঙ্গেয় উপসাগর বলা হতো। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে চোল রাজত্বে একে বলা হয়েছিল চোল হ্রদ। পরে বঙ্গদেশের সংলগ্ন উপসাগর হিসাবে, এর নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গোপসাগর (বঙ্গ +উপসাগর)। এর বাংলা শব্দটি উৎপত্তি সংস্কৃত ভাষার বঙ্গশব্দ থেকে যা দ্বারা গঙ্গা মোহনার জল বোঝায়।

বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এই উপসাগরে অবস্থিত। ভারতের প্রধান সমুদ্র বন্দরের মধ্যে কাকিনাদা, চেন্নাই, বিশাখাপত্মম, কলকাতা, ধামরা, পন্ডিচেরী এবং পারাদিপ। মায়ানমারের পূর্ববর্তী রাজধানী ও সর্ববৃহৎ নগরী ইয়াংগুন, বঙ্গোপসাগরের একটি উল্লেখযোগ্য সমুদ্রবন্দর।

গিনি উপসাগর

গিনি উপসাগর আফ্রিকার একটি বৃহত্তম উপসাগর ও এর উপকূলবর্তী দেশ সমূহ হচ্ছে লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, ঘানা, টোগো, বেনিন, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, নিরক্ষীয় গিনি, গ্যাবন। নাইজারভোল্টা নদী গিনি উপসাগরে এসে পতিত হয়েছে। গিনি উপসাগরের অন্তর্গত অনেক দ্বীপ রয়েছে। যার মধ্যে অ্যানোবন, ববোওয়াসি দ্বীপ, বিওকো, করিস্কো, এলোবে চিকো উল্লেখযোগ্য।

Gulf of Guinea
ছবি : সংগৃহীত

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন