কিছু প্রণালীর পরিচিতিঃ পর্ব ৩

দুই ধারে দৃষ্টিনন্দন স্থলভুমি, আর মাঝ দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমান জল। এই ধরনের পানিপথকেই বলা হয় প্রণালী (Strait)। প্রণালী হল দুটি নদী বা সমুদ্রের সংযোগকারী সংকীর্ণ জলপ্রবাহ বা ধারা। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের আগে যখন জলপথ ছিল দুটি দেশের মাঝে যোগাযোগের সেরা মাধ্যম, তখন থেকেই মানুষ বিভিন্ন প্রণালীর গুরুত্ব বুঝতে পারে। এই প্রণালীগুলো শুধু প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাসেও তাদের রয়েছে প্রত্যক্ষ অবদান। আজ তৃতীয় পর্বে থাকছে বাব-এল-মান্দেব, জোহর ও সেলেটান প্রণালী।

  • বাব-এল-মান্দেব

Bab_el_Mandeb_NASA_with_description
ছবি : সংগৃহীত

ইয়েমেন, জিবুতি ও ইরিত্রিয়ার মাঝে অবস্থিত এই প্রণালীটি মান্দেব প্রণালী নামে পরিচিত। প্রণালীটি লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে। বাব-এল- মান্দেব একটি আরব নাম যার অর্থ অশ্রুর দরজা বা অশ্রুদ্বার। এছাড়া, আরব দেশের একটি লোককথা অনুযায়ী এক ভয়ংকর ভূমিকম্পের ফলে যখন এশিয়া এবং আফ্রিকার ভূখণ্ড আলাদা হয়ে যায়, সেই সময় অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

অর্থনৈতিকভাবেও মান্দেব প্রণালী গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মাঝে এই প্রণালীটি লোহিত সাগর ও সুয়েজ খাল হয়ে সংযোগ স্থাপন করেছে। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৬ সালে এ প্রণালীটি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩.৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল বহন করা হয় যেখানে সমগ্র বিশ্বে তেলবহনকারী ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে বহন করা হয় গড়ে ৪৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। ইয়েমেন থেকে জিবুতিতে মান্দেব প্রণালীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ মাইল(৩০ কিলোমিটার)। পেরিম নামক একটি দ্বীপ এই প্রণালীকে দুটি চ্যানেলে ভাগ করেছে। এদের একটি হলো পূর্বদিকে, যার নাম বাব ইস্কান্দার (অ্যালেক্সান্ডারের প্রণালী) যা ৩ কিলোমিটার চওড়া এবং ৩০ মিটার গভীর। অপর চ্যানেলটি পশ্চিমপাশে, এর নাম দাক্ত – আল –মায়ুন যা ২৫ কিলোমিটার চওড়া এবং ৩১০ মিটার গভীর। জিবুতির উপকূলের কাছে একগুচ্ছ ছোট ছোট দ্বীপ আছে। এদেরকে একত্রে বলা হয় সেভেন ব্রাদার্স

ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানীদের কাছেও এই প্রণালীর গুরুত্ব রয়েছে। Recent single origin hypothesis অনুযায়ী আমাদের আদিপুরুষ অর্থাৎ বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট আধুনিক মানুষ আফ্রিকা থেকেই গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছেন এবং তারাও এই প্রণালীটি সম্ভবত প্রত্যক্ষ করেছেন। ধারণা করা হয় যে, সেই সময় সমুদ্রের পানি অনেক কম ছিল তাই এই পথ দিয়ে আদিমানবরা আফ্রিকা থেকে এশিয়াতে পা রেখেছিলেন।

  • জোহর প্রণালী

300px-Singapore-Johor_Causeway
ছবি : সংগৃহীত

সিঙ্গাপুরে অবস্থিত এই প্রণালীটি তেব্রাউ প্রণালী নামেও পরিচিত। মালয়েশিয়ার একটি স্টেট জোহরকে এই প্রণালীটি সিঙ্গাপুর থেকে আলাদা রেখেছে। এই প্রণালীটি তার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।

জোহর প্রণালীর সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানটি হলো লিদো বিচ, যা প্রণালীর মালয়েশিয়ান অংশে রয়েছে। ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বিচে পর্যটকরা হাঁটতে বা সাইকেল চালাতে পারেন। এছাড়া, এখানে রয়েছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট যেখানে মজাদার খাবার পাওয়া যায়।

বর্তমানে দুটি মানবসৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এই প্রণালীতে। একটি হলো  Johor-Singapore Causeway যা জোহর আর সিঙ্গাপুরের Woodlands এর মাঝে সংযোগ সৃষ্টি করেছে। আরেকটি হলো একটি ব্রিজ যা  Malaysia-Singapore Second Link নামে পরিচিত।

এছাড়া, ১৯৪৫ সালে এখানে লেফটেনেন্ট ইয়ান এডওয়ার্ড এবং লিডিং সিম্যান ম্যাগেনিসের নেতৃত্বে ৯৮৫০ টন জাপানিজ ক্রুজার Takao ডুবানো হয়, যার জন্য উল্লেখিত দুইজন ভিক্টোরিয়া ক্রস পদক পান।

  • সেলেটান প্রণালী

সেলেটান প্রণালী পেনাং প্রণালী ও “সাউথ চ্যানেল” নামেও পরিচিত। এই চ্যানেলটি পেনাং দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড পেনিনসুলার মালয়েশিয়া থেকে পৃথক করেছে। প্রণালীর পূর্বদিকে রয়েছে মূল ভূখণ্ড Seberang Perai এবং পশ্চিমদিকে রয়েছে পেনাং দ্বীপ। এই প্রণালীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর উত্তর এবং দক্ষিন দিক যুক্ত হয়েছে মালাক্কা প্রণালীর সাথে – যা পৃথিবীর ব্যস্ততম সামুদ্রিক পথের মধ্যে অন্যতম।

এই প্রণালীর মাঝে বেশ কিছু দ্বীপ রয়েছে, যার মাঝে সবচেয়ে বড় দ্বীপটি হলো জেরেজাক। অতীতে এটি লেপার কলোনির একটি অংশ ছিল। বর্তমানে এটিকে পর্যটন স্পটে পরিণত করার কাজ চলছে।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন