ফলের রাজা আম

 

বাংলাদেশে  বিভিন্ন জাতের ফল আছে।তবে আমের মতো এত সুস্বাদু ফল আর নেই। আমের যেমন ঘ্রাণ, তেমনি মজাদারও বটে। তাইতো বলা হয়, ফলের রাজা আম। আম আঁটিযুক্ত ফল। আম দিয়ে বানানো হয় চাটনি, আচার, আমসত্ত্ব, জুস। গ্রীষ্মকালে আমের সঙ্গে দুধ-কাঁঠাল মিশিয়ে মজাদার খাবার তৈরি হয়। দেখতে গোলাকার, ডিম্বাকার, হূৎপিণ্ডাকার, লম্বা বা সরু নানা আকৃতিতে হয়ে থাকে। আম খুব রসাল ফল। কাঁচা আমের রং সবুজ।পাকলে অনেকটা হলদেটে এবং কমলা মিশ্রিত লাল আভা যুক্ত। কোনো কোনো জাতের আম আছে, যা পাকলেও সবুজ দেখা যায়।আকার ভেদে একেকটি আমের ওজন ৭৫০ গ্রাম থেকে প্রায় এক কেজি হয়ে থাকে। এসব আমের বিভিন্ন রকম নাম আছে। ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত, কাঁচামিষ্টি, হিমসাগর, আম্রপালি, খিরসাগর, ফজলি, কিষাণভোগ, মোহনভোগ, মিছরিভোগ, গুঁটি, লখনা, আশ্বিনা সহ আমাদের দেশে কয়েকশ প্রজাতির আম রয়েছে।

আম নিয়ে গল্প কথা

মহাভারতে আম নিয়ে মজার এক গল্প রয়েছে। সীতা কে রাবণ অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কায়। বন্দী অবস্থায় সীতাকে ফল খাওয়ানো হয়। নাম না-জানা ফল খেয়ে খুব মজা পায় সীতা।নিজের ভাগের অংশ থেকে সীতা কয়েকটা ফল রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমানের জন্য রেখে দেয়। কদিন পর সীতার খোঁজে হনুমান গেল লঙ্কায়। ঠিকঠিক হাজির হয় বন্দী সীতার কাছে। সীতা হনুমানকে ওই ফল দিয়ে বলে, এগুলো তোমার, রাম ও লক্ষ্মণের জন্য।তোমরা খেয়ো। হনুমান সেই ফলগুলো থেকে একটা ফল খেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি। সব ফল একাই খেয়ে ফেলে। ফিরে যায় সীতার কাছে।বলে, মা, আমি অপরাধ করেছি। ফলগুলো রাম ও লক্ষ্মণকে না দিয়ে একাই খেয়েছি। এখন বলো এই ফলের নাম কী? কোথায় পাওয়া যায়? সীতা বলে, আমি তো এখানে বন্দী। কোথায় কী আছে আমি বলতে পারব না। এই ফলের কী নাম, তা-ও জানি না। তবে আশপাশেই পাওয়া যাবে হয়তো। খোঁজ করে দেখতে পারো।হনুমান ফলের সন্ধানে বের হয়।

এত স্বাদের ফল, কী নাম এর? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় আম বাগান।গাছ থেকে একটি আম খেয়ে হনুমান বুঝতে পারল, সীতার দেওয়া ফলের মতো এই ফলেরও একই রকম স্বাদ। আম গাছে উঠে হনুমান ইচ্ছেমতো খেতে থাকে আর আমের আঁটি এদিক-সেদিক ছুড়ে মারতে থাকে। কথায় বলে, হনুমানের ছুড়ে দেওয়া আমের আঁটি থেকেই এই ভারত উপমহাদেশে জন্ম হয়েছে আম গাছের।

আম গাছের ইতিহাস

আম গাছ নিয়ে প্রচলিত গল্পে বলা হয়, ৬৩২-৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে চীন দেশের পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষে বেড়াতে আসেন। সেই সময় তিনি ফল হিসেবে আমকে পরিচিত করে তোলেন।এরপর জানা যায় যে মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর শাসন আমলে ভারতের লাখবাগেরদার ভাঙা এলাকায় প্রায় এক লাখ আম গাছ রোপণ করেছিলেন।এটি কে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় আম বাগান।মূলত মোগল সম্রাটদের আমলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতের আমের উদ্ভাবন হয়েছে।আমের ইংরেজি নাম Mango। বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাংগিফেরা ইন্ডিকা।

উন্নতজাতের আম

বাংলাদেশের সব অঞ্চলে আমের চাষ হলেও উন্নতজাতের আম হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুর এলাকায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজারকে আম বাজারের রাজধানী বলা হয়। এছাড়া শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, আলীনগর, রহনপুর এলাকায় আমের বড় বাজার বসে। এখান থেকে আম ব্যবসায়ীরা আম কিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করেন।

আমের পুষ্টিগুণ

আমের অনেক পুষ্টি গুণ রয়েছে। উচ্চমাত্রার চিনি, ভিটামিন ‘এ’এবং ভিটামিন ‘সি’রয়েছে এই ফলে। আমে রয়েছে ভিটামিন ‘বি’কমপ্লেক্স। এই ভিটামিন শরীরের স্নায়ুগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। শরীরকে রাখে সতেজ।ঘুম আসতে সাহায্য করে।আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ।আঁশ-জাতীয় ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, মুখের ব্রণ প্রতিরোধ করে।চিকিৎসকদের মতে, আমে খনিজ লবণের উপস্থিতি ও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে।দাঁত, নখ, চুল, মজবুত করার জন্য আমের খনিজ লবণ উপকারী ভূমিকা পালন করে।বুদ্ধি ও শরীরের শক্তি বাড়ানোর জন্য আম ভীষণ জরুরি ফল।

জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ

বাংলাদেশের যেদিকে তাকানো যায়, চোখে পড়ে আম গাছ।কি শহরে, কি গ্রামে ! সহজলভ্য এই আম গাছ তাই জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কেন আম গাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হলো এর কয়েকটি কারণও আছে।

– আম গাছ দেশের সর্বত্রই সহজে জন্মায়।

– আমাদের জাতীয় সংগীতে আম গাছের কথা আছে। ‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগলকরে…’

– মহান ভাষা আন্দোলনের সময় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়।

– ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে।এটি মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত।

– ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে ব্রিটিশদের হাতে পলাশীর আমবাগানে।

– আম গাছের কাঠ দিয়ে আসবাব বানানো যায় ও জ্বালানি হিসেবেও কাজে লাগে।

– আম সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ফল। খেতে সুস্বাদু।

– দেশের প্রায় সব এলাকায় আম গাছ দেখা যায়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন