ফসিলের বয়স নির্ধারণে কার্বন ১৪

প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাঝে মাঝে এমন সব ফসিল খুঁজে বের করেন যা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়। এমন অদ্ভুত ও হাজার বছরের পুরানো সব ফসিলের আবিষ্কারের ফলেই আমরা আমাদের অতীত সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। মানুষের বিবর্তনের কথাই ধরা যাক। আমরা ফসিল থেকে জানতে পেরেছি যে প্রাচীনকালে মানুষের আকার-আকৃতি অন্যরকম ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষের বিভিন্ন সময়কালের ফসিল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ফসিল দেখে কিভাবে বুঝলেন যে কোন ফসিলের বয়স কত?

ফসিলের বয়স নির্ণয়ের অন্যতম জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো কার্বন ডেটিং। প্রথমে আমরা ফসিল সম্পর্কে জেনে নেই। প্রাণীর মৃতদেহ থেকে ফসিল তৈরি হয়। কোন প্রাণী বা গাছ যখন মারা যায় তখন সেই প্রাণীর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে মাটির সাথে মিশতে শুরু করে। প্রাণীর দেহের নরম অংশগুলো যেমন মাংসে দ্রুত পচন ধরে। কিন্তু হাড় বা খোলসের মতো শক্ত জিনিসগুলো এতো দ্রুত পচন ধরে না। মাঝে মাঝে এইসব হাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মাটির বিভিন্ন পদার্থ যেমন – ক্যালসিয়াম প্রবেশ করে হাড়গুলোকে আরো মজবুত করে তুলে যার ফলে এইসব টিকে থাকে হাজার হাজার বছর। এই হাড়গুলো তখন ফসিলে পরিনত হয়।

ফসিলের বয়স নির্ধারণে কার্বনের বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। একটি ফসিলে কি পরিমান কার্বন-১৪ আছে এটা নির্ণয় করতে পারলেই সেই ফসিলের বয়স সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কার্বন-১৪ হলো কার্বনের তেজষ্ক্রীয় রূপভেদ। এখন প্রশ্ন হলো কার্বন-১৪ এর এমন কি বিশেষ গুণাবলী আছে যে তা দিয়ে বয়স নির্ণয় করা যায়? 

এই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে কার্বনের পারমাণবিক গঠন থেকে। আমরা জানি যে সকল পদার্থ মূলত ৩টি মৌলিক কণা দ্বারা গঠিত – ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। একেকটি মৌলের প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রন সংখ্যা একেক রকম। যেমন কার্বনের প্রোটন সংখ্যা ৬ আর নাইট্রোজেনের প্রোটন সংখ্যা ৭। আমরা প্রকৃতিতে যে কার্বনের সাথে পরিচিত তা মূলত কার্বন-১২। অর্থাৎ এই কার্বনে ৬টি প্রোটন ও ৬টি নিউট্রন থাকে। কিন্তু প্রকৃতিতে এমন কার্বন অণুও আছে যেখানে নিউট্রনের সংখ্যা হলো ৮টি। এই কার্বন অণুগুলোকে বলা হয় কার্বন-১৪। কার্বন-১৪ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এরা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে কার্বন-১৪ অণু থেকে প্রোটনের সংখ্যা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং একসময় কার্বন-১৪ অণু নাইট্রোজেন পরমাণুতে পরিণত হয়। অর্থাৎ কোন বস্তুতে কিছু পরিমান কার্বন-১৪ অণু থাকলে ধীরে ধীরে সেই বস্তুর কার্বন-১৪ এর পরিমাণ কমতে থাকবে।

প্রতিটি প্রাণীর শরীরেই কার্বন থাকে। প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদ সরাসরি কার্বন -ডাই অক্সাইড গ্রহনের মাধ্যমে কার্বন গ্রহন করে আর সেই প্রাণীরা সেই উদ্ভিদ খেয়ে প্রকৃতির কার্বন গ্রহণ করে। গৃহীত এই কার্বনের বেশিরভাগ অংশই কার্বন-১২ তবে এতে কিছু পরিমান কার্বন-১৪ ও থাকে। তাই প্রাণীর ফসিলে থাকা কার্বনের মাঝে কার্বন-১৪ ও উপস্থিত থাকে। বিজ্ঞানীরা যখন কোন ফসিল পান তখন সেই ফসিলে কি পরিমান কার্বন-১২ আর কি পরিমান কার্বন-১৪ আছে তা পরীক্ষা করে বের করেন। আগে বেটা কাউন্টিংয়ের মাধ্যমেই কার্বন-১৪ এর পরিমাণ নির্ণয় করা হত। তবে বর্তমানে এক্সেলেটর মাস স্পেক্ট্রোমিটারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ফসিলের কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত নির্ণয় করেন।

যেহেতু কার্বন-১৪ এর পরিমান সারাক্ষণ কমতে থাকে তাই যে ফসিলে কার্বন-১৪ এর অনুপাত কম সেই ফসিলের বয়স বেশি। কার্বন-১৪ এর অর্ধায়ু প্রায় ৫৭৩০ বছর। অর্থাৎ কিছু পরিমান কার্বন-১৪ নেওয়া হলে সেই কার্বন-১৪ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অর্ধেকে পরিনত হতে সময় নিবে প্রায় ৫৭৩০ বছর। যে সময়ে কোন তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাকে ঐ পদার্থের অর্ধায়ু বলে। কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার বছরের পুরানো ফসিলের বয়স পর্যন্ত নির্ণয় করা যায়।

 

 

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন