হরতাল-অবরোধ কেবল রাজনীতির ময়দান বা জনদুর্ভোগেই আটকে নেই আর, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা এবং মননেও এর কুপ্রভাব পৌঁছে গেছে । লালমাটিয়া একাডেমিয়ায় ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া আমার সন্তান এখনই বিতৃষ্ণ হয়ে গেছে রাজনীতির এই হানাহানি এবং মারপ্যাঁচ দেখে, এবং এখন থেকেই তাদের প্রজন্ম সব রকম শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলছে রাজনীতির উপর থেকে । এই যে গোটা একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে রাজনীতির প্রতি খারাপ ধারণা এবং অশ্রদ্ধা নিয়ে, তার প্রভাব কিন্তু ভবিষ্যতেও থেকে যাবে । হরতালে বন্ধ থাকলেও বাধ্য হয়ে অবরোধে স্কুল-কলেজের ক্লাস খোলা রাখা হচ্ছে, কিন্তু নিরাপদে স্কুলে পৌঁছানো বা বাড়ি ফিরে আসাও মস্তবড় দুশ্চিন্তা হয়ে থাকছে । পেট্রোলবোমা বা ককটেল ছোঁড়ার ঘটনা এখন আর দূর-দূরান্তে আটকে নেই, রাজধানীর একেবারে প্রাণকেন্দ্রগুলো এখন আর রক্ষা পাচ্ছে না দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে । তাছাড়া আমরা যারা সন্তানদের স্কুলের কাছাকাছি এলাকায় থাকছি তারা হয়তোবা বিপদ মাথায় করেও বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করছি, কিন্তু যারা কিছুটা দূরে বসবাস করে তারা সে সাহসটুকুও করে উঠতে পারছেন না । তাই অবরোধে স্কুল খোলা রাখা হলেও উপস্থিতির হার শোচনীয়ভাবে কম থাকে । আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার সিংহভাগই যেহেতু স্কুলকেন্দ্রীক, স্কুলে যা পড়ানো হয় তাই তারা বাসায় এসে চর্চা করে । কিন্তু হরতাল বা অবরোধে বহু ছাত্র-ছাত্রীই অনুপস্থিত থাকায় ক্লাসগুলোতেও একই পড়া আবারো পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে । সে কারণে বাচ্চারাও পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে । কোচিং বা টিউওশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে শিক্ষাবর্ষ জুনে শেষ হলেও পড়াশোনার এই যে ব্যাঘাত, তাতে করে বার্ষিক পরীক্ষা কাছাকাছি চলে এলেও সিলেবাস অনুযায়ী সব পড়া শেষ করা অসম্ভবই থেকে যাবে । পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান বা নাচ শেখার প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে । অর্থাৎ আমাদের শিশুদের আমরা বঞ্ছিত করছি শিক্ষার সমস্ত সুযোগ থেকে । আমাদের রাজনৈতিক হানাহানি কেবলমাত্র সাময়িক জ্বালাও-পোড়াও এর মধ্যেই ক্ষান্ত থাকছে না, ভবিষ্যত প্রজন্মকেও বঞ্ছিত করছে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে, যাদের উপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তারাই আজ বেড়ে উঠছে চরম অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তায় । দেশের সকল রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তাই আমার অনুরোধ, অন্তত নিষ্পাপ শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেও তারা যেন হানাহানি আর সংঘাতের পথ এড়িয়ে চলেন ।