কিছুদিন আগেও, কোনো ব্যাটসম্যান বোল্ড আউট হলে দেখা যেতো বেল আর স্ট্যাম্পগুলো উড়ে গিয়ে কিছুদূরে পড়তো। কিন্তু ইদানিংকালে দেখা যায় বোল্ড আউটের পর বেল আর স্ট্যাম্পগুলো রঙ্গিন হয়ে যায়। মিট মিট করে জ্বলতে থাকে। এটা দেখতে যেমন চোখ ধাঁধানো, তেমনি অনেক কার্যকরীও। ক্রিকেটের এই নতুন সংস্করণটির নাম হচ্ছে এলইডি (LED) স্ট্যাম্প। LED এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Light Emitting Diode। এই এলইডি স্ট্যাম্প এই বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও দেখা যাচ্ছে।
ক্রিকেট খেলা দিন দিন আধুনিক থেকে হচ্ছে আধুনিকতর। প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাচ্ছে ক্রিকেট খেলা ততই হচ্ছে অত্যাধুনিক। ক্রিকেট খেলায় প্রতিটি ষ্ট্যাম্পে ও বেলে তার দিয়ে এলইডি বাল্ব সংযুক্ত থাকে। তারের মধ্যে দিয়ে কম পরিমাণের তড়িৎ প্রবাহিত হয়। ষ্ট্যাম্পে বল লাগলেই বেল পড়লেই এই বাল্বটি জ্বলে ওঠে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ষ্ট্যাম্পের ভিতরে Gyroscope Sensor থাকে যা মূলত বেলের সূক্ষ্মতম নড়াচড়া বলে দিতে পারে। তাই, ষ্ট্যাম্পে বল লাগলেই যদি বেল উপরে উঠে তাহলে লাল বাতি জ্বলে ওঠে আর তখন বেল পড়ে যাওয়া মানে ব্যাটসম্যান আউট। লাল বাতি মানেই যে ব্যাটসম্যানের অশনিসংকেত না তারও একটি দৃষ্টান্ত এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ঘটেছে। আরব আমিরাত ও আয়ারল্যান্ডের খেলায় আরব আমিরাত দলের বোলার আমজাদ জাভেদের বল ষ্ট্যাম্পে লেগে বেল উপরে উঠে গিয়েছিলো কিন্তু আয়ারল্যান্ডের ব্যাটসম্যান এড জয়েস আউট হয়েনি। কেননা বেল উপরে উঠে গেলেও বেল পড়েনি অর্থাৎ বেল উপরে উঠেও তা আবার জায়গামতো বসে পড়েছে। কি সৌভাগ্য ব্যাটসম্যানের ! বোলারের জন্যও দুঃখ লাগছে এই ঘটনা দেখে !
এলইডি এমন একটি ডায়োড যা কিনা একটি সেমিকন্ডাক্টর এবং আলো বিকিরণ করে। ডায়োড মূলত একটি নির্দিষ্ট দিকের তড়িৎ প্রবাহকে সহায়তা করে এবং তার বিপরীত দিকের তড়িৎ প্রবাহকে বাধা প্রদান করে। আর যে বস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে রোধ বা Resistance হ্রাস পায় তাকে সেমিকন্ডাক্টর বলে। সিলিকন, জার্মেনিয়াম, আর্সেনাইড, ইনডিয়াম ইত্যাদি হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টরের উদাহারণ। এলইডি অর্ধপরিবাহী যৌগ দ্বারা প্রস্তুত করা হয় এমনভাবে যেন তাদের বেশিরভাগ শক্তি আলো হিসেবে নির্গত হয়। এই আলোর বর্ণ ব্যবহৃত বস্তুর উপাদানের উপর নির্ভর করে।
ক্রিকেটের আধুনিক সংস্করণগুলোর মধ্যে এই এলইডি স্ট্যাম্প অন্যতম ১টি। এলইডি স্ট্যাম্প সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য হচ্ছে :-
-
এ স্ট্যাম্পের আবিষ্কারের ফলে আম্পায়ারদের দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘটনা কমে আসবে। কারণ, স্ট্যাম্পের শীর্ষ থেকে বেল সামান্য সরে গেলেও বাতি জ্বলে উঠবে। বল আঘাত করার সাথে সাথে বাতি জ্বলে উঠে স্ট্যাম্প এবং বেলগুলোতে।
-
এলইডি স্ট্যাম্পের ধারণা প্রথম আসে অস্ট্রেলিয়ান মেকানিক্যাল ডিজাইনার ব্রন্টে একারম্যান কাছ থেকে। এ ধারণা পরবর্তীতে বাস্তব রূপ দেন দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানী “জিং ইন্টারন্যাশনাল”
-
প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে একটি প্রীতি ম্যাচে এ স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ান বিগ ব্যাশ লিগে এ স্ট্যাম্প ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
-
প্রায় তিন বছরের গবেষণার পর এটিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্বাগতম জানানো হয়।
-
দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে এ স্ট্যাম্পের ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এলইডি স্ট্যাম্পের অভিষেক হয়।
-
ধারণা করা হচ্ছে আইপিএল এর পরবর্তী আসরেও এই স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হবে।
আগে যেমন ম্যাচ জিতার পর বিজয়ী দল স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে উদযাপন করতো, এখন হয়তো সেটি আর হবে না। এলইডি স্ট্যাম্পগুলো অনেক কার্যকরী হলেও অস্বাভাবিক রকমের ব্যয়বহুল। কারণ প্রতি ম্যাচের এক সেট বেল-স্ট্যাম্পের পেছনে খরচ প্রায় ৪০,০০০ ইউএস ডলার। আর প্রতিটি বেলের দাম প্রায় একটি আইফোনের দামের সমান। তাহলে বুঝে দেখো যদি একটি স্ট্যাম্প ভেঙ্গে যায় তাহলে কি পরিমাণ খরচ করতে হয় ICC কর্তৃপক্ষের ! ! আশা করা যাচ্ছে, অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এর দাম কমে আসবে। আর ৫-৬ বছর পরে পাড়ার ক্রিকেটেও এই LED বাল্বের স্ট্যাম্প দেখলে অস্বাভাবিক লাগার কথা নয় অবশ্যই, তাই নয় কি ?
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৪ টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও এই স্ট্যাম্পের ব্যবহার করা হয়।
এলইডি যে ক্রিকেট খেলার ষ্ট্যাম্পেই ব্যবহার হয় তাই নয় কিন্তু মোবাইল ফোনের কি-প্যাড জ্বলে এলইডির কারণে। রাস্তায় ইদানিং যে বড় স্ক্রিনের টিভি দেখা যায় তাও অসংখ্য এলইডি এর সমন্বয়। এছাড়া, অপটিক্যাল যোগাযোগ, ইনফ্রারেড রশ্মি, আলোকসজ্জা, ট্রাফিক সিগন্যাল, এলইডি টিভি, অপটিক্যাল মাউস, লেজার রশ্মি উৎপাদন সহ আরো অনেক কাজে এলইডি ব্যবহৃত হয়।