হরতাল অবরোধে পেট্রল বোমার আঘাতে মানুষ পুড়িয়ে মারার সহিংসতা দাগ কেটেছে খুদে শিক্ষার্থীদের মনেও। আর তাই কীভাবে এই সহিংসতা থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানো যায় তারই একটি উপায় বের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুলের দশম শ্রেণীর দুই শিক্ষার্থী।
আবদুল্লাহ রুপম এবং এস এম আকাশ। 'সেফ ফ্রম পেট্রল বম্ব' নামের একটি প্রজেক্ট নিয়ে তারা অংশ নিয়েছে ৮ম ঢাকা রেসিডেন্সিশিয়াল মডেল কলেজ জাতীয় বিজ্ঞান উৎসব ২০১৫’র আসরে।
কীভাবে পেট্রল বোমা থেকে মানুষ এবং যানবাহনকে বাঁচাবে তাদের এই পদ্ধতি? জানতে চাইলে আবদুল্লাহ রুপম বলেন, তাদের এই পদ্ধতিতে পুরো গাড়ির জানালার চারপাশে একটি টিউব থাকবে। টিউবের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে ফায়ার এক্সটিংগুইসার। যখন কোনো পেট্রল বোমা গাড়ির জানালায় আঘাত করবে এবং আগুন ধরে যাবে তখন এই টিউব আগুনে গলে গিয়ে ফায়ার এক্সটিংগুইসার থেকে আসা কার্বন-ডাই-অক্সাউট দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলবে।
এতে করে পেট্রল বোমায় হতাহতের পরিমাণ অনেক কমে যাবে বলে তারা মনে করেন। আর একটি বাসে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মোট খরচ পড়বে মাত্র ৭-৮ হাজার টাকা। বাসের মত ব্যবহার করা যাবে ট্রেনেও। এরকম শত শত বিজ্ঞানভিত্তিক প্রদর্শনী নিয়ে ঢাকা রেসিডেন্সিশিয়াল মডেল কলেজে শুরু হয়েছে ৮ম ডিআরএমসি বিজ্ঞান উৎসব ২০১৫।
সকাল ৯টায় উৎসবের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সুবহানী।
প্রধান অতিথি ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা মেধা ও মননে কোনো অংশেই কম নয়। তারা তাদের খুদে মস্তিষ্ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে যে সব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে তা যদি বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে দেশের অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। দরকার শুধু তাদেরকে একটু উৎসাহ দেওয়া। সহযোগিতা করা। এরপর অতিথিরা কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।
এছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার বিষয়ক বিশেষ সেমিনারে উৎসবে আগত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন চ্যাম্পস টোয়েন্টিওয়ান ডটকমের সিইও রাসেল টি আহমেদ। তিনি বলেন, প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত তার অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে যে কোন কিছু শেখার জন্য দিনে অন্তত এক ঘন্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করা। এতে তারা সারা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারবে।
হরতাল অবরোধে রেল লাইন তুলে ফেলে যাত্রীদের জিম্মি করা হচ্ছে। ভেঙ্গে পড়ছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর থেকে মুক্তির উপায় বের করেছে শেরে বাংলা নগর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর তিন শিক্ষার্থী নাজমুল রেজা রাহাত, সাজ্জাদ হোসেন তানজীব এবং মাহিনুর রহমান।
তাদের 'রেল লাইনের অতন্দ্র প্রহরী' নামের এই প্রকল্পে পুরো রেল লাইন জুড়ে থাকবে একটি বিদ্যুৎ লাইনের তার। যখন কেউ রেল লাইন উপড়ে ফেলতে চাইবে তখন তারটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একটি বার্তা পাঠাবে রেল স্টেশনে। এর ফলে রেল স্টেশন থেকে স্টেশন মাস্টারের আগাম বার্তা পৌছে যাবে ট্রেনের চালকের কাছে। এতে ট্রেন দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর তিন শিক্ষার্থী সেগুফতা শাহরীন, আজমী আলম ও লেইশী হুমায়রা পারভীন নিয়ে এসেছেন একটি পরিবেশ বান্ধব হাইড্রোলিকস আর্মস।
এই আর্মস দিয়ে সহজেই কন্সট্রাকশন এবং কৃষি কাজ করা যাবে। তাতে লাগবে না কোনো জ্বালানি। শুধুমাত্র বাতাসের চাপ ব্যবহার করেই চালানো যাবে এই যন্ত্র। তারা পানির চাপ প্রয়োগ করে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখিয়ে দিচ্ছিলেন আগত দর্শনার্থীদেরকে।
হলিক্রস কলেজের তিন শিক্ষার্থী শ্রাবন্তী সাহা, কানযুদ সাইয়ারা ও শ্রেয়া সাহা নিয়ে এসেছেন কী করে মাটি ছাড়াই বিভিন্ন ফল-ফুল এবং শাক সবজির চাষ করা যায়।
তাদের মতে, গাছ মাটি থেকে যেসব পুষ্টি উপাদান গ্রহন করে তা যদি আমরা পানিতে মিশিয়ে দেই তাহলে সে পানি থেকে গাছ তার দরকারী পুষ্টি গ্রহণ করে বড় হবে। তারা ক্যাপসিকাম, পালং শাক, স্ট্রবেরি এবং বিভিন্ন ফুলের গাছ এই পদ্ধতিতে বালতিতে চাষ করে তা নিয়েও এসেছেন উৎসবে।
তরল পুষ্টি কোথায় মিলবে তার হদিসও তারা বলে দিচ্ছিলেন দর্শনার্থীদের। রেসিডেন্সিশিয়াল মডেল কলেজেরই ৬ষ্ঠ শ্রেণীর দুই ক্ষুদে শিক্ষার্থী আনাফ আবরার হোসেন ও তাশমির শিকদার তূর্য বানিয়েছেন সোলার কার। কোনো রকম তেল ছাড়া শুধুমাত্র সৌরশক্তি ব্যবহার করেই চলে এই কার। তাদের আশা বড় হতে হতে তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবহারের জন্য বানিয়ে ফেলবে এমন গাড়ি।
তিনদিনব্যাপি আয়োজিত এই উৎসবে এমন প্রকল্প প্রদশর্নী ছাড়াও রয়েছে কুইজ, ম্যাথ, জেনারেল সাইন্স, প্রোগ্রামিং, দেয়াল পত্রিকা, রুবিকস কিউব, স্ক্র্যাপ বুক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ, অ্যাপস তৈরি, রবোটিকস কর্মশালা। উৎসবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ইউনিভাসির্টি, হায়ার সেকেন্ডারী, সেকেন্ডারী এবং জুনিয়র সেকেন্ডারী এই চার পর্বে ভাগ করা হয়েছে।
সকাল ৮টায় প্রতিযোগিদের রিপোর্ট জমাদানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। এরপর প্রধান অতিথির ভাষণ, প্রজেক্ট ডিসপ্লে, ওয়াল ম্যাগাজিন ও ফটোগ্রাফি ডিসপ্লে করা হয়।
এর সঙ্গে অডিটোরিয়াম এবং তিন নম্বর ভবনে বিভিন্ন গ্রুপের প্রতিযোগিদের নিয়ে উপস্থিত বক্তৃতা, কুইজ, ম্যাথ এবং ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড, সাইন্স সেমিনার, ক্রস ওয়ার্ড প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
বিকাল ৫.৩০ মিনিটে অ্যাস্ট্রনোমি অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের অনুষ্ঠান। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত বিজ্ঞান উৎসবটি। আজ থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব শেষ হবে আগামী শনিবার।