দুই ধারে দৃষ্টিনন্দন স্থলভুমি, আর মাঝ দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমান জল। এই ধরনের পানিপথকেই বলা হয় প্রণালী (Strait)। প্রণালী হল দুটি নদী বা সমুদ্রের সংযোগকারী সংকীর্ণ জলপ্রবাহ বা ধারা। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের আগে যখন জলপথ ছিল দুটি দেশের মাঝে যোগাযোগের সেরা মাধ্যম, তখন থেকেই মানুষ বিভিন্ন প্রণালীর গুরুত্ব বুঝতে পারে। এই প্রণালীগুলো শুধু প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাসেও তাদের রয়েছে প্রত্যক্ষ অবদান। আজ পঞ্চম পর্বে থাকছে ইংলিশ চ্যানেল, ড্রেক প্যাসেজ ও তাতার প্রণালী।
- ইংলিশ চ্যানেল
দেখতে অনেক সরু বলে ইংলিশ চ্যানেলকে অনেক সময় শুধু “দি চ্যানেল” নামেও ডাকা হয়। ইংল্যান্ডের দক্ষিন অংশকে ফ্রান্সের উত্তর অংশ থেকে এটি আলাদা করে রেখেছে ও সেই সাথে উত্তর সাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। এটি প্রায় ৫৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর প্রস্থ সর্বোচ্চ ২৪০ কিলোমিটার এবং ডোভারের প্রণালীতে এর প্রস্থ সর্বনিম্ন ৩২.৩ কিলোমিটার।
ইংলিশ চ্যানেলের নাম নিয়ে জটিলতা রয়েছে। ব্রিটিশরা একে সেই অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ইংলিশ চ্যানেল নামে ডাকছে। ডাচরা একে Het Kanaal নামে ডাকে। পরবর্তীতে এটি “ব্রিটিশ চ্যানেল” নামেও পরিচিত হয়েছে। ফ্রেঞ্চরা এই চ্যানেলকে সেই সপ্তদশ শতাব্দী থেকে la Manche নামে ডাকছে। স্প্যানিশ আর পর্তুগিজরাও বাদ যাবে কেন? স্প্যানিশরা এর নাম দিয়েছে el Canal de la Mancha আর পর্তুগিজরা এর নাম দিয়েছে Canal da Mancha। তবে উচ্চারনে মিল থাকলেও স্প্যানিশ আর পর্তুগিজদের নাম ঠিক ফ্রেঞ্চ নাম থেকে আসেনি। কারন ফ্রেঞ্চ ভাষায় Manche অর্থ “Sleeve” আর পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ভাষায় Mancha অর্থ “Stain” । জার্মানরা এই চ্যানেলকে Ärmelkanal নামে ডাকে, যার অর্থ Sleeve Channel।
ইংলিশ চ্যানেলের প্রধান দ্বীপগুলোর মধ্যে আছে আইল অব ওয়াইট এবং চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জ। প্রধান বন্দরগুলোর মধ্যে আছে ফ্রান্সের শেরবুর্গ ও ল্য আভ্র এবং গ্রেট ব্রিটেনের সাউদাম্পটন। ছোট বন্দরগুলোর মধ্যে আছে গ্রেট ব্রিটেনের ডোভার, প্লাইমাউথ ও পোর্টসমাউথ এবং ফ্রান্সের কালে। এ বন্দরগুলোর মধ্যেই নিয়মিত ফেরি সংযোগ আছে। রেল ফেরিগুলো কোনো বিরতি ছাড়াই লন্ডন ও প্যারিসের মধ্যে যাত্রী পরিবহন করে। ডোভার ও কালে শহরের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে আধা ঘণ্টার হোভারক্রাফট পরিবহনের ব্যবস্থা আছে। ১৮০২ সালে ইংলিশ চ্যানেলের নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝিতে এসে এটির খননকাজ শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে কাজটি সমাপ্ত হয় এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে যাত্রী গাড়ি ও ট্রাক পরিবহন করা হয়।
একেক দেশে একেক নাম থাকার অন্যতম কারন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব।ভৌগলিক কারণেই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ অতীতের অনেক যুদ্ধেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে ইংলিশ চ্যানেল। ফরাসি ও ব্রিটিশদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দর্শন ইত্যাদির আদান-প্রদানেও ভূমিকা রেখেছে এটি। ১৮৭৫ সালে ম্যাথু ওয়েব নামক এক ব্রিটিশ প্রথম ইংলিশ চ্যানেল সাঁতার কেটে অতিক্রম করেন। ব্রজেন দাস প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের কৃতিত্ব দেখান।
- ড্রেক প্যাসেজ
ড্রেক প্যাসেজটি “মার দে হচেস” (সি অব হচেস) নামেও পরিচিত। বিখ্যাত নাবিক হচেসের নামানুসারে এই নাম রাখা হয়েছে। এটি দক্ষিন আমেরিকার কেপ হর্ন থেকে অ্যান্টার্কটিকার সাউথ শেল্টার আইল্যান্ডস পর্যন্ত বিস্তৃত। ড্রেক প্যাসেজ আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিন-পশ্চিমাংশকে প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিন-পূর্বাংশের সাথে যুক্ত করেছে। এই প্যাসেজের ইংরেজি নামকরণ করা হয় ষোড়শ শতাব্দীর ব্রিটিশ প্রাইভেটিয়ার স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকের নামানুসারে। ১৬১৬ সালে ডাচ নাবিক Willem Schouten এই প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে প্রথম সমুদ্রযাত্রা করেন।
৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রণালীটি অ্যান্টার্কটিকা থেকে যেকোনো দেশের ভূমিতে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম পথ। পৃথিবীর জলপ্রবাহে এই প্রণালীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই প্রণালীর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া Antarctic Circumpolar Current এর মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমান পানি প্রবাহিত হচ্ছে (যা কিনা আমাজন নদীর প্রবাহিত পানির প্রায় ৬০০ গুন বেশি)। এই পথ দিয়ে জাহাজও চলাচল করে। যাত্রীরা এখানে ডলফিন, তিমি এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক পাখি যেমন অ্যালবাট্রস, পেঙ্গুইন, জায়ান্ট পেট্রেলের দেখা পাওয়া যায়।
দক্ষিন আমেরিকার গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ম্যাজেলান প্রণালী ও দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম প্রান্তে তিয়ের্রা দেল ফুয়েগো দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত বিগ্ল প্রণালীর পথ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে এই দুইটি প্রণালীর মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করা কঠিন বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া তো রয়েছে অনেক বেশি ঝড়ো হাওয়া আর পানির স্রোত। তাই, অভিযাত্রীরা ড্রেক প্যাসেজ দিয়ে ভ্রমণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে।
- তাতার প্রণালী
৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ তাতার প্রণালী রাশিয়ান শাখালিন দ্বীপপুঞ্জকে পৃথক করেছে দক্ষিণ-পূর্ব রাশিয়া থেকে। তাতার প্রণালী সংযুক্ত করেছে ওখটস্ক সাগর ও জাপান সাগরকে। এই প্রণালীটির গভীরতা ৪-২০ মিটার। তাতার প্রণালীর উল্লেখযোগ্য সমুদ্রবন্দর হচ্ছে Vanino। ১৯৭৩ সাল থেকে Vanino থেকে Kholmsk পর্যন্ত রেল ফেরি চলাচল অব্যাহত আছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা Joseph Vissarionovich Stalin এর সময়ে তাতার প্রণালীর নিচ দিয়ে ভূগর্ভস্থ রেলপথ নির্মান কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে Stalin এর মৃত্যুর পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া, ১৯৮৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাখালিন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত মনোরন দ্বীপে সোভিয়েত বাহিনী গুলি করে ভূপাতিত করে কোরিয়ান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ০০৭ নামের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজটি এবং মারা যান ২৬৯ আরোহীর সবাই।