শুরু হয়ে গেছে ২০১৫ বিশ্বকাপ ক্রিকেট, আর এই জমকালো খেলার আসর নিয়ে ক্রিকেট ভক্তদের মাঝে উন্মাদনার শেষ নেই। যার যার প্রিয় দল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছেই। এর পাশাপাশি আমরা দিয়ে যাচ্ছি ক্রিকেট সম্পর্কীয় কিছু মজার সাধারণ তথ্য।
হয়তোবা তোমরা গতকালের জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা দেখেছো ? ক্রিস গেইলের ব্যাটিং তাণ্ডবও নিশ্চয় দেখেছো তোমরা ? আচ্ছা, তোমরা কি লক্ষ্য করেছো ম্যাচের ফলাফলে কি লিখা ছিলো যে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিম্বাবুয়েকে ৭৩ রানে হারিয়েছে। আজ তোমাদের ডাকওয়ার্থ-লুইস সম্বন্ধে কিছু বলবো।
ক্রিকেট ম্যাচের সবচেয়ে বড় শত্রু হল বৃষ্টি, এমন অনেক নজির আছে যে বৃষ্টির কারণে পুরো ম্যাচ পরিত্যাক্ত ঘোষণা করতে হয়েছে। আবার অনেক সময়ে এক দল ব্যাট করে অন্য দল নামলে বৃষ্টি শুরু হয়, এমন অবস্থায় ম্যাচ চালু রাখা যায় না, আবার পরিত্যাক্তও করা যায় না। শুধু বৃষ্টি না, আরও বিভিন্ন কারণে একটি ক্রিকেট ম্যাচে সমস্যা দেখা দিতে পারে যার কারণে এক সময়ে ম্যাচ আর চালু রাখা যায় না। কিন্তু ম্যাচ যে পর্যন্ত হয়েছে, তার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই জয়-পরাজয় নির্ধারণের একটি চমৎকার রীতি প্রচলিত রয়েছে, যার নাম ডাকওয়ার্থ-লুইস রীতি। ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ ফ্র্যাঙ্ক ডাকওয়ার্থ ও টনি লুইস এই রীতির উদ্ভাবন করেন এবং তাঁদের নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয়।
একটা উদাহারণ দিয়ে শুরু করা যাক। ২০০৬ সালের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ভারত ৫০ ওভারে ৩২৮ রানে অলআউট হয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান ব্যাট করতে নেমে ৪৭ ওভার পর্যন্ত ৭ উইকেটে ৩১১ রান সংগ্রহ করে। কিন্তু তখনই রাত হয়ে যায় এবং স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের আলো পর্যাপ্ত না হওয়ায় ম্যাচ আর চালু রাখা সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করে ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করা হয় এবং তার অনুসারে পাকিস্তান ৭ রানে জয়লাভ করে।
এবার আসা যাক এই পদ্ধতি দিয়ে কিভাবে ফলাফল নির্ণয় করা হয় তার ব্যাপারে। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে একটি দলের হাতে থাকা উইকেট ও ওভারের ওপর ভিত্তি করেই ফলাফল বের করা হয়। একটি দলের বাকি থাকা উইকেট ও ওভারকে বলা হয় ঐ দলের “Resource”। প্রথমে যে দল ব্যাট করতে নামে, তাকে বলে প্রথম দল (T1) এবং পরে যে দল ব্যাট করতে নামে তাকে বলে দ্বিতীয় দল (T2)। T1-এর Resource-কে R1, এবং T2-এর Resource-কে R2 বলা হয়। প্রথম দলের অর্জিত মোট রানকে বলা হয় “S”। এখন, যদি R2
বাকি থাকা ওভার |
বাকি থাকা উইকেট |
||||
১০ |
৮ |
৬ |
৪ |
২ |
|
৫০ |
১০০.০ |
৮৫.১ |
৬২.৭ |
৩৪.৯ |
১১.৯ |
৪০ |
৮৯.৩ |
৭৭.৮ |
৫৯.৫ |
৩৪.৬ |
১১.৯ |
৩০ |
৭৫.১ |
৬৭.৩ |
৫৪.১ |
৩৩.৬ |
১১.৯ |
২০ |
৫৬.৬ |
৫২.৪ |
৪৪.৬ |
৩০.৮ |
১১.৯ |
১০ |
৩২.১ |
৩০.৮ |
২৮.৩ |
২২.৮ |
১১.৪ |
০ |
১৭.২ |
১৬.৮ |
১৬.১ |
১৪.৩ |
৯.৪ |
মনে করা যাক, দুটি দলের মধ্যে T1 প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ৩১৫ রান সংগ্রহ করলো। দ্বিতীয় দল ব্যাট করতে নেমে ২০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ১১৫ রান অর্জন করলো এবং এ পর্যায়ে বৃষ্টির জন্য ম্যাচ আর চালু রাখা সম্ভব না হওয়ায় ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করা হল। এখন, প্রথম দল ৫০ ওভার ও ১০ উইকেটই ব্যবহার করতে পেরেছে, অর্থাৎ, তাদের R1=১০০%.
দ্বিতীয় দলের হাতে বাকি ছিল ৩০ ওভার ও ৬ উইকেট। সুতরাং, তাদের R2=১০০%-৫৪.১%=৪৫.৯%। যেহেতু, এখানে R2
অতএব, এক্ষেত্রে সূত্রটি হবে, SXR2/R1=৩১৫X৪৫.৯/১০০=১৪৪.৫৯। অর্থাৎ, দ্বিতীয় দলের জেতার জন্য ২০ ওভার ও ৪ উইকেটে ১৪৫ রান সংগ্রহ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, যেহেতু তারা ১১৫ রান অর্জন করেছে, অতএব ম্যাচটিতে প্রথম দলই জয়লাভ করবে।
ডাকওয়াআর্থ-লুইস পদ্ধতি সবসময়ে যে প্রশংসিত হয়েছে, তা নয়। যেমন একটি দল শেষের ১০ ওভারে ধুন্ধুমার চার-ছক্কা পিটিয়ে ম্যাচের ফলাফল পাল্টে দিতে পারে, কিন্তু ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে এসব গণনা করা হয়না। আসলে এটা শুধু মাত্র বাধাপ্রাপ্ত ম্যাচের জন্য যেখানে ফলাফল নির্ণয়ের আর কোন উপায় থাকে না, সেখানেই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির সৃষ্টির ইতিহাস অনেক নাটকীয়। ডাকওয়ার্থ-লুইসের আগে ওভারের সেরা রানের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। ওভারের সেরা রানের পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে এক পর্যায়ে ১ বলে ২১ রান করার জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। অথচ, ১ বলের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৬ রান তোলা যায়। বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় এ বিতর্কের অবসান ঘটেছে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে। নির্দিষ্ট সময়ে খেলা শেষ করার পূর্ব মুহুর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রানের। কিন্তু সংক্ষিপ্ত ১২ মিনিটের বৃষ্টি পর্বের ফলে তাদেরকে ২১ রান করতে বলা হয় মাত্র ১ বলে যা ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয়। যদি ডি/এল মেথড প্রয়োগ করা হতো তাহলে ঐ খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে চার রান করলে টাই কিংবা পাঁচ রান করলে জয়লাভের জন্য নির্দেশনা দেয়া যেত।
অবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকার আরেকটি হৃদয়বিদারক ম্যাচের কাহিনী দিয়ে শেষ করি।
২০০৩ বিশ্বকাপে স্বাগতিক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাই। তাই সমর্থকদের প্রত্যাশাও ছিল আকাশচুম্বী। অথচ নিজ দেশের বিশ্বকাপে পোলকের দক্ষিণ আফ্রিকা ছিটকে পড়লো প্রথম রাউন্ড থেকেই! দক্ষিণ আফ্রিকার ২০০৩ বিশ্বকাপের শুরুটা ছিল হতাশাজনক। নিউজিল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের পর গ্রুপের শেষ ম্যাচ ছিল শ্রীলংকার বিপক্ষে। সুপার সিক্সে উঠতে হলে এই ম্যাচে জিততেই হতো প্রোটিয়াদের। অন্যদিকে শ্রীলংকার জন্যও অপরিহার্য ছিল জয় তাই সমীকরণ এমন ছিল যে দুই দলের মধ্যে যে হারবে তাকে বিদায় নিতে হবে বিশ্বকাপ থেকে।
ডারবানের কিংসমিডে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আগে ব্যাট করে শ্রীলংকা ৯ উইকেটে ২৬৮ রানের স্কোর গড়ে। ওপেনার মারভান আতাপাত্তু ১২৪ রান এবং ৭৮ বলে ৭৩ রান করেন অরবিন্দ ডি সিলভা। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ওপেনার গ্রায়েম স্মিথ এবং হার্সেল গিবস ওপেনিং জুটিতে করেন ৬৫ রান। স্মিথ ৩৪ বলে ৩৫, এবং গিবস ৮৮ বলে করেন ৭৩। ডি সিলভা, জয়াসুরিয়া এবং মুত্তিয়া মুরালিধরণকে সামলাতে না পেরে কিছু উইকেট খুইয়ে বসে সাউথ আফ্রিকা।
হঠাৎ ডারবানের আকাশে ভিড় করে অভিশপ্ত কালো মেঘ। বৃষ্টির কারণে ডার্কওয়ার্থ লুইস নিয়ম অনুসারে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য নতুন লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৪৫ বলে ৫৭ রান।৪৫তম ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুম থেকে মার্ক বাউচারের কাছে পাঠানো বার্তায় জানানো হয় ৪৬তম ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে ২২৯ তুললেই পরের রাউন্ডে যাবে সাউথ আফ্রিকা। মুরালিধরনের করা ওভারের পঞ্চম বলটিকে ডিপ মিড উইকেটের উপর দিয়ে ছক্কা মারেন বাউচার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোর এক বল বাকি থাকতেই ২২৯। বাউচার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন তা ভেবে মুরালির ষষ্ঠ বলটি ধীরে সুস্থে মিড উইকেটে খেলেন কিন্তু কোন রান নিলেন না ।
পরপরই আকাশ ভেঙে নামলো তুমুল বৃষ্টি। হঠাৎই পরিলক্ষিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে রাজ্যের হতাশা! অধিনায়ক শন পোলক বসে আছেন গালে হাত দিয়ে আর পাশেই মাখায়া এনটিনির চোখেমুখে উল্লাসের পরিবর্তে অসম্ভব নীরবতা! পোলকের হিসাবের ভুলে ছিটকে গেছে সাউথ আফ্রিকা!বাউচারকে পাঠানো বার্তায় পোলক জানান, ২২৯ রান করলে ম্যাচটি জিতবে সাউথ আফ্রিকা।কিন্তু আসলে জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ২৩০ রান!