শীতের আবেশ কাটিয়ে প্রকৃতির নতুনরুপে জেগে উঠা। চারিদিকে গাছের নতুন পাতা, পলাশ-শিমুল গাছে রঙের খেলা, কোকিলের কুহু কুহু ডাকে মানবমনে লাগে দোলা। আর এসবই হলে বুঝতে হবে বসন্ত এসে গেছে। ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানাতেই প্রকৃতি ও জীব এমনভাবে জানান দেয়।
ফাল্গুনের হাত ধরেই বসন্তের আগমন। পয়লা ফাল্গুন বা পহেলা ফাল্গুন বাংলা পঞ্জিকার একাদশতম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বসন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব পালিত হয়। বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশ্যাসহ অন্যান্য রাজ্যে দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ এই দিনকে বরণ করতে চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিবছর জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজন করে থাকে।
কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এই বসন্ত উৎসব কিভাবে এলো?
বসন্ত উৎসবকে দোলযাত্রাও বলা হয়। দোলযাত্রা মূলত একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব বলেই বিবেচিত। ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই মনে করেছিলো। অনেকে আবার একে গ্রীকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করতো।
বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিলো তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্রে’ দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি।
সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে।
মূলত পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলো মূলত দুই প্রকার: প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলনায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে রঙ খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।
দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এক সামাজিক অনুষ্ঠানও বটে, যার সার্বজনীন আবেদন আছে। দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এখন আর শুধুমাত্র সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে হোলি খেলা নয়, বরং সব ধর্মের নারী পুরুষের মধ্যেই রঙ খেলার প্রবণতা দেখা যায়।
মধ্যযুগে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জী হিসেবে আকবরি সন বা ফসলী সনের প্রবর্তন করেন। সেসময় ১৪টি উৎসব পালনেরও রীতি প্রবর্তিত হয়। এর অন্যতম ছিলো বসন্ত উৎসব। সেসময় বাংলার সকল সম্প্রদায়ের মানুষই বসন্ত বরণে বিভিন্ন লোকজ উৎসব ও মেলায় অংশ নিতেন। পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উদযাপনের রীতিও ঐতিহ্যবাহী।
শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯০৭ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেছিলেন ঋতুরঙ্গ উৎসব। সেদিন শান্তিনিকেতনের প্রাণ কুঠিরের সামনে শুরু হয় এ উৎসব। এখন অবশ্য সেদিনের প্রাণকুঠি শমীন্দ্র পাঠাগার হিসেবে পরিচিত। সেই ঋতুরঙ্গ উৎসবই আজকের বসন্ত উৎসব। আগে বসন্তের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হতো এ উৎসব। পরবর্তীকালে অবশ্য বসন্ত পূর্ণিমার দিনই অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। এ উৎসব অবশ্য ঋতুরাজ বসন্তে স্বাগত জানানোর উৎসব।
ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আরিয়ান জাতির কাছ থেকে এই উৎসবের জন্ম। হোলি উৎযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে থেকেই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায় খ্রিস্ট জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থ বেদ এবং পুরাণেও। ৭০০ শতকে দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশে বসন্ত উৎসব
বাংলাদেশিদের নিজস্ব সত্ত্বা জেগে ওঠে এই বসন্তের ঋতুতেই, ১৯৫২’র ভাষার দাবীতে যখন বাংলার মানুষ পথে নেমেছিলো, গুলি খেয়েছিলো, জহির রায়হানের সঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছিলো, আগামী ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো। প্রতিবাদস্বরূপ বাঙালি আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে আগ্রহী হয়। ষাট দশক থেকেই পহেলা ফাল্গুনে হলুদ শাড়ি পরা নতুনভাবে শুরু হয় বলে জানা যায়। তবে অনেক আগে থেকেই ছোটখাটোভাবে একেক জায়গায় এই উৎসব পালন করা হতো।
বাংলাদেশে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে।
এখন শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের প্রায় সব জেলায় এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এই উৎসব পালন করা হয়। বাঙালীর উদযাপনে একটি সার্বজনীন উৎসব হয়ে গেছে বসন্ত উৎসব।
অনলাইন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের অবলম্বনে