বাংলাদেশের কিছু চোখ জুড়ানো জলপ্রপাতঃ পর্ব ১
বর্ষাকাল কিন্তু ঘুরতে যাবার একটা দারুণ সময়। বিশেষ করে ঝর্ণা বা জলপ্রপাত দেখার সেরা সময় এটি। বর্ষার বৃষ্টিতে ঝর্ণাগুলো তাদের প্রকৃত রূপ ধারণ করে। এমনিতে যেসব ঝর্ণায় সারা বছর পানি থাকে সেগুলো বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উঠে। আর অন্য সময় যেগুলো মরা থাকে বর্ষা আসলে সেসব ঝর্ণার মধ্যে আবারও প্রাণের সঞ্চার হয়। সেই সাথে পানির স্রোতে সৃষ্টি হয় সাময়িক অনেক ঝর্ণা।
আগের পর্বে আমরা বাংলাদেশের কয়েকটি চোখ জুড়ানো জলপ্রপাত সম্পর্কে জেনেছিলাম। এই পর্বে থাকছে আরও কয়েকটি ঝর্ণার বর্ণনা।
হামহাম ঝর্না
হামহাম বা হাম্মাম বা চিতা ঝর্ণা, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝর্ণা। দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝর্ণাটি ১৩৫ ফুট বা তার কিছু বেশি উঁচু। তবে এই ঝর্ণার ব্যাপ্তি মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের ব্যাপ্তির প্রায় তিনগুণ।
হামহাম ঝর্ণার নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ ঝর্ণার সাথে গোসলের সম্পর্ক করে “হাম্মাম”(গোসলখানা) শব্দটি থেকে “হামহাম” হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, সিলেটি উপভাষায় “আ-ম আ-ম” বলে বোঝানো হয় পানির তীব্র শব্দ আর এই ঝর্ণা যেহেতু সেরকমই শব্দ করে তাই সেখান থেকেই ভাষান্তরে তা “হাম হাম” হিসেবে প্রসিদ্ধি পায়। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি “চিতা ঝর্ণা” হিসেবে পরিচিত, কেননা একসময় এজঙ্গলে নাকি চিতাবাঘ পাওয়া যেত।
অন্যান্য ঝর্ণার মতই হামহামের যৌবন দেখা যায় বর্ষাকালে। এসময় প্রচন্ড ব্যাপ্তিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। ঝর্ণার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে হয়। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরিপথ ও ছড়ার কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। হামহাম যাবার পথ এবং হামহাম সংলগ্ন রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি কদম গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রং-বেরঙের প্রজাপতি। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য চশমাপরা হনুমানের।
হামহাম যাবার সবচেয়ে সহজ রাস্তা হচ্ছে শ্রীমঙ্গল হয়ে যাওয়া। ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। সেখান থেকে লেগুনা, চান্দের গাড়ি বা সিএনজি করে যেতে হবে কলাবন পাড়া। এরপর প্রায় দেড় থেকে ২ ঘণ্টা হাঁটলে দেখা মিলবে এই অপরূপ ঝর্ণার। যাওয়ার সময় স্থানীয় কাউকে গাইড হিসেবে নিয়ে যাওয়া ভালো নতুবা জঙ্গলে পথ হারানোর সম্ভাবনা থাকতে পারে। সাথে করে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং শুকনা খাবার নিয়ে যেতে হবে। সেই সাথে জঙ্গলে মশা, পোকামাকড় এবং জোঁক থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
জাদিপাই ঝর্ণা
জাদিপাই ঝর্ণার নাম সাধারণ পর্যটকদের কাছে একটু অপরিচিতই শোনাতে পারে। তবে ট্র্যাকিং করতে ভালবাসেন তাদের কাছে এটি খুবই পরিচিত একটি নাম।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত জাদিপাই ঝর্ণা। এই ঝর্ণার উচ্চতা ও প্রশস্ততা সম্পর্কে সঠিক জানা না গেলেও এটি যে বাংলাদেশের অন্যতম বড় ঝর্ণা সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর বর্ষাকালে জাদিপাইয়ের রূপ অনন্য। এসময় এ ঝর্ণা থেকে এমনই শব্দ করে পানি আছড়ে পড়ে যে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কারোর কথাও স্পষ্ট শোনা যায় না। বিশাল এ ঝর্ণার মোহে আবিষ্ট হয়ে অনেকক্ষণ আপনি কোন কথা খুঁজে পাবেন না।
জাদিপাই যাবার রাস্তা বেশ দুর্গম। অভিজ্ঞ ট্র্যাকার না হলে এই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে যাত্রা না করাটাই উত্তম। যথেষ্ট মনোবল আর শারীরিক সক্ষমতাও থাকা প্রয়োজন এ ঝর্ণায় যেতে চাইলে। জাদিপাই যাওয়ার জন্য প্রথমেই আপনাকে যেতে হবে বান্দরবান শহরে। সেখান থেকে লোকাল বাস বা চান্দের গাড়ি করে রুমা বাজার। রুমা বাজার থেকে আবারও চান্দের গাড়ি নিয়ে যেতে হবে বগালেক। তবে সবসময় বগালেক পর্যন্ত গাড়ি যায় না। প্রয়োজনে ১-২ ঘণ্টা হাঁটতেও হতে পারে। রাতটা কাটিয়ে দিন বগালেকের কটেজে। সেখানে পাহাড়িদের তৈরি করা কটেজে থাকা ও খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে।
পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু করুন। ৪-৫ ঘণ্টা হাঁটার পর আপনি পৌঁছে যাবেন সরকারীভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের ২য় সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডং-এ। সেখান থেকে আরও দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে নামলে পাবেন জাদিপাই পাড়া। এই পাড়া পার হয়ে কিছুদূর এগোলেই কানে আসবে জাদিপাইয়ের পানির গর্জন আর সে শব্দ অনুসরণ করলেই পেয়ে যাবেন কাঙ্ক্ষিত জাদিপাই ঝর্ণা।
শুভলং ঝর্ণা
হামহাম বা জাদিপাইয়ের মতো অতোটা দুর্গম নয় শুভলং ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তা। বরং কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় এই ঝর্ণার কাছে।
রাঙামাটির বরকল উপজেলার শুভলং-এর পাহাড়ি ঝর্ণা ইতোমধ্যেই পর্যটকদের কাছে সুপরিচিত। এই ঝর্ণার নির্মল জলধারা পর্যটকদের হৃদয়ে এক ভিন্ন অনুভূতির কাঁপন তোলে। ভরা বর্ষা মৌসুমে মূল ঝর্ণার জলধারা প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ে এবং অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
রাঙ্গামাটি সদর হতে শুভলং এর দুরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার, পর্যটন ঘাট ও রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে স্পীড বোট ও নৌ-যানে করে সহজেই শুভলং ঝর্ণায় যাওয়া যায়। কাপ্তাই লেকের জলপথে পাহাড়ের বুক চিরে আঁকা-বাঁকা চলার পথে যাওয়ার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের অপার সৌন্দর্য চোখে পড়বে।
ছবিঃ সংগৃহীত