বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বা বাংলা বর্ষপঞ্জি হলো বঙ্গদেশের সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। কবে থেকে এবং কীভাবে বঙ্গাব্দের সূচনা হলো সে সম্পর্কে ২টি মত চালু আছে। প্রথম মত অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গদেশের রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন শশাঙ্ক।
আধুনিক বঙ্গ, বিহার ও ওড়িশার অধিকাংশ এলাকা তার সাম্রাজ্যের অন্তভুক্ত ছিল। ধারনা করা হয়, জুলীয় বর্ষপঞ্জীর বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।
দ্বিতীয় মত অনুসারে, ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে সকল রাজকর্ম পরিচালিত হত। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। তার কারণ সৌর বছর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিন। যে কারণে চান্দ্র বছরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না।
আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজগলো মুলত বিভিন্ন ঋতুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। যার কারণে ভারতের মোগল সম্রাট আকবর সেই সময় প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেন।
সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ তার নবরত্ন সভার সদস্য আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন।
তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এ জন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। যার জন্য বৈশাখ মাসকে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
এরও অনেক পরে ষোল শতকে সংস্কৃত পন্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য সম্পাদিত বাংলা সনের ‘নবদ্বীপ পঞ্জিকা’ প্রকাশিত হয়। এটিই ছিলো প্রথম মুদ্রিত বাংলা সনের পঞ্জিকা।
দেশভাগের পর ১৯৫২ সালে ভারত সরকারের তত্বাবধানে আবারো বাংলা সনের সংস্কার শুরু হয়। অন্যদিক বাংলা সনের পুরনো নিয়মে মাসের হিসেব নিদির্ষ্ট করা যায় না তাই ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। এই কমিটির মতে বাংলা মাস ২৯ ও ৩২ দিনের পরিবর্তে প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং শেষ ছয় মাস ৩০ দিন ধার্য করা হয়। আর প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো খ্রিস্টীয় সনের পাশাপাশি সরকারীভাবে বাংলা সন লেখার চল শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। বাংলাদেশে পঞ্জিকা রচনায় ভারতের মানমন্দিরের সময়সূচির সহযোগিতা নেওয়া হয়। এই সময়সূচি নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় সময় যোগ-বিয়োগ করে পঞ্জিকা পরিবর্তন করা হয়। পঞ্জিকার ক্ষেত্রে চাঁদের তিথিকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়।