আধুনিক বিশ্বে প্রায় সবকিছুই আমাদের হাতের মুঠোয় এলেও এখনও আমরা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে পারিনি। যেমন বাতাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি বাতাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে আমরা শুধু সাবধানতাই অবলম্বন করতে পারি, কিন্তু থামাতে পারি না। তবুও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি আমাদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেও এর মতিগতি ঠিকই বুঝতে পারি।
যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত যাতায়াত করার জন্য বিমানের বিকল্প নেই। কিন্তু বিমান তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের মত ঝামেলাও আর কোনকিছুতে পোহাতে হয় না। বিমান চালনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাতাসের গতির সাথে এর তাল মেলানো। ভূমি থেকে কয়েক হাজার ফিট ওপরে অভিকর্ষ বল, বাতাসের গোলমেলে গতি, তাপমাত্রার পরিবর্তন প্রভৃতি মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ির মতো অবস্থা তৈরি হয়। এমন পরিবেশেই বিমানকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। বিমান তৈরির সময় একে এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে বাতাসের প্রচন্ড গতি সহ্য করেও অনায়াসে চলতে পারে। কিন্তু একটি বিমান তৈরির পর তা মাটি থেকে কয়েক হাজার ফিট ওপরে টিকে থাকবে কিনা তা মাটিতে থেকে কিভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব!
এই পরীক্ষা করার জন্য এক ধরণের সুড়ঙ্গ ব্যবহার করা হয়। এটি “বায়ু সুড়ঙ্গ” (Wind Tunnel) নামে পরিচিত। বিমানচালনাবিদ্যায় বায়ু সুড়ঙ্গ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। প্রচন্ড গতির বাতাস কঠিন বস্তুকে কিভাবে পাশ কাটিয়ে যাবে এবং তা বস্তুটির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে তা অনায়াসেই বায়ু সুড়ঙ্গ দিয়ে পরীক্ষা করা যায়।
বায়ু সুড়ঙ্গ দিয়ে কয়েক হাজার ফিট ওপরের বায়ুর গতির সমগতিসম্পন্ন বায়ু প্রবাহিত করা হয়, এবং পরীক্ষামূলক বস্তুটিকে এর ভেতর রাখা হয়। এর ফলে বস্তুটির সহনশীলতা সহজেই পরীক্ষা করা যায়। বিমান তৈরির পর তা এমনি একটি বিশাল বায়ু সুড়ঙ্গের মধ্যে রেখে তার ভেতর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত করা হয়। বায়ু সুড়ঙ্গের ব্যবহার বিমান তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশাল বিশাল সব বায়ু সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল এবং যুদ্ধে আক্রমণের জন্য তৈরি বিমানগুলোকে এর মধেই পরীক্ষা করা হত। সুপারসনিক বা শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী বিমান তৈরিতে বায়ু সুড়ঙ্গই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস। এছাড়াও জেট বিমান ও মিসাইলের গতি পরীক্ষা করতে বায়ু সুড়ঙ্গের বিকল্প নেই।
১৮৭১ সালে গ্রেট ব্রিটেনের এক গবেষক সর্বপ্রথম বায়ু সুড়ঙ্গ তৈরি করেন। কঠিন বস্তুর ওপর প্রচন্ড গতির বাতাস কতটুকু চাপ ফেলে, এবং তার ফলে বস্তুটির অবস্থা কি দাঁড়ায় তা পরীক্ষা করতেই তিনি এই যন্ত্রটি তৈরি করেন। বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর সবচেয়ে আধুনিকায়িত মডেলটি তৈরি করেন জার্মান বিজ্ঞানীরা। এয়ারক্রাফট এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত যানবাহন তৈরিতে মিত্রবাহিনীর চেয়ে জার্মানি অনেকাংশেই এগিয়ে ছিল। যুদ্ধের শেষে দেখা যায় জার্মানির কাছে কম করে হলেও তিনটি বায়ু সুড়ঙ্গ ছিল যেগুলো দিয়ে সুপারসনিক বিমান তৈরি সম্ভব।
বায়ু সুড়ঙ্গ কাজ করে সুড়ঙ্গের মতই। এর দুটি মুখ থাকে, একটি বাতাস শুষে নেয়া হয়, অপরটি দিয়ে বাতাস প্রবাহিত করা হয়। সামনের দিকে বেশ কয়েকটি স্বয়ংক্রিয় বিশাল বিশাল পাখা যুক্ত থাকে যেগুলো প্রচন্ড গতির বাতাস প্রবাহিত করতে পারে। আবার পেছনের দিকে এমনি আকারের পাখা বাতাসকে শুষে নেয়, যার ফলে বাতাসের গতি আরও বেড়ে যায়, এবং ভেতরে স্থাপিত বস্তুটির ওপর প্রচন্ড গতিতে আঘাত হানে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বায়ু সুড়ঙ্গের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। এরপর থেকে শুধু বিমান নয়, বরং মানুষের তৈরি অনেক যানবাহনই বায়ু সুড়ঙ্গের পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে লাগলো।
সবচেয়ে বেশী এর মধ্যে পরীক্ষা করা হয় আধুনিক গাড়ি। উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি গাড়িগুলো প্রচণ্ড দ্রুতগামী হয়, আর তাই এদের বাতাসের চাপ কতটুকু সহ্য করতে হয় তা আর বলার বাকি থাকে না। ঘণ্টায় ৩০০-৩৫০ কিঃ মিঃ গতিতে যাওয়ার সময় বাতাসের প্রচণ্ড চাপে এদের অবস্থা কি দাঁড়ায় তা পরীক্ষা করতে এদের বায়ু সুড়ঙ্গের টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।