“ভাঙ্গারি “- শব্দটার সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। আমাদের যাবতীয় ভাঙ্গা, নষ্ট জিনিসপত্র, অকেজো যন্ত্রাংশ – এইগুলো যারা আমাদের কাছ থেকে কিনে নেয় বা যেসব দোকানে এগুলো সংগ্রহ করে সেগুলোকেই আমরা ভাঙ্গারি বলি। মজার বিষয় হচ্ছে, নষ্ট উড়োজাহাজ যেখানে জমা করে রাখা হয়, ওগুলোও কি তাহলে ভাঙ্গারি ? অনেকে ভাবতেই পারেন, আবার অনেকেই দ্বিমত পোষণ করে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এগুলোকে ভাঙ্গারী না বলে “Aircraft Boneyard” বলা হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, উন্নত দেশগুলো তাদের নষ্ট বা ব্যবহার অনুপযোগী উড়োজাহাজগুলো সংরক্ষণকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এই সংরক্ষণশালা বা ভাঙ্গারিগুলোই হয়ে উঠছে জাদুঘর !!
সেরকম কিছু Boneyard দেখে নেয়া যাকঃ
AMARG, Arizona, USA:
মার্কিন এই বিমান সংগ্রহশালাকে সাংবাদিকরা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ভাঙ্গারি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অদ্ভুতুড়ে এই নামের পূর্ণরূপ হল Aerospace Maintenance and Regeneration Group। যার আরেক নাম Davis-Monthan Air Force Base। এই বিশাল বিমান সংগ্রহশালাটির অবস্থান অ্যারিজোনার মরুভূমিতে। বিস্তর এই মরুভূমিতে প্রায় ৪৪০০টিরও বেশি ব্যবহার অনুপযোগী বিমান তথা যুদ্ধবিমান সারিবদ্ধ ভাবে রাখা রয়েছে। পূর্বে এখান থেকে মিলিটারি এয়ার সাপোর্ট দেয়া হতো, পরিত্যক্ত বিমানগুলো তারই সাক্ষ্য বহন করে। Hercules Freighters, A10 Thunderbolts, The F-14 Tomcat fighters – কি নেই এখানে !!! যুদ্ধবিমানের এক যাদুঘর বললেও ভুল হবে না !! আবার, বিভিন্ন সিনেমার ব্যাকড্রপ হিসেবে এই স্থানের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি, Transformers: Revenge of the Fallen সিনেমাটিতে এর ব্যাকড্রপ ব্যবহার করা হয়েছে।
Mojave Air and Space Port:
ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতে অবস্থিত এই সংগ্রহশালাটির আরো বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। যার সূচনা ১৯৩৫ সালে। পূর্বে এখানে বিমানের ১০০০ মাইল রেসের আয়োজন করা হত। পরে অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা আর বায়ুপ্রবাহের আধিক্যের কারণে রেস বন্ধ করে দেয়া হয়। ফ্লাইং টেস্টের জন্যও এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে এই সংগ্রহশালাটি আলোচনার কেন্দ্রে থাকার কারন হল, বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা হিসেবে গণনা করা হয় এই সংগ্রহশালাটিকে । সিনেমার শ্যুটিং এর জন্য পরিচালকদের প্রথম পছন্দ এই সংগ্রহশালাটি, যদিও শ্যুটিং এর জন্য খরচও নেহাত কম নয় এখানে। এই বিমান সংগ্রহশালায় যেসব উল্লেখযোগ্য সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে Die Hard 2, S.W.A.T, Speed, Dragnet ইত্যাদি।
Alice Springs Airport:
অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত এই সংগ্রহশালাটি আয়তনে খুব একটা বড় না হলেও, আমেরিকার বাহিরে সবচেয়ে বড় বিমানের সংগ্রহশালা এটিই। ১৯২১ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার এই সংগ্রহশালাটি। এই বিমান সংগ্রহশালাটির আধুনিকায়নে সময় লেগেছে প্রায় ৩৭ বছর। এতে কেবল ২ টি রানওয়ে রয়েছে। রানওয়ের সংখ্যা কম হলেও লম্বা রানওয়েতে খুব সহজেই বোয়িং ৭৪৭ কিংবা ৭৭৭ এর মত বিশাল বিমান অবতরন করতে পারে।
সংগ্রহশালাটি বিখ্যাত হবার পেছনের কারণটি হলো, ১৯৭২ সালের ১৫ই নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিমান Ansett Fokker F27 Friendship ছিনতাইয়ের সাথে এটি সম্পৃক্ত, যা একে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় নিয়ে আসে। বর্তমানে বিমান সংরক্ষন ছাড়াও স্থানীয় ফ্লাইট উঠা-নামার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।
Museum of Civil Aviation , Ulyanovsk, Russia:
রাশিয়ার এক বিখ্যাত যাদুঘর, যাকে যাদুঘর বলার চেয়ে শুধুমাত্র সংগ্রহশালা বা ভাঙ্গারি বলাই শ্রেয়। বিকল বিমান, যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি এখানে রয়েছে অনেক ২য় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ কিছু হেলিকপ্টার। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, বিমানগুলোকে দেখলে মনে হবে এগুলো বাগানের মধ্যে সাজানো !!
RAF Shawbury, UK :
RAF এর পূর্ণরূপ Royal Air Force । ১৯১৭ সালে প্রথমে ব্রিটিশ সৈন্যদের ফ্লাইং ট্রেনিং এর জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় একে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত সেনাবাহিনীদের প্রশিক্ষণ চলে এখানে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে RAF এর ভঙ্গুর অবস্থানের কারণে, ১৯২০ সালে এই প্রশিক্ষণশালা বন্ধ করে জমিগুলো কৃষকদের দিয়ে দেয়া হয়। মজার বিষয়,২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৩৮ সালে এই প্রশিক্ষণশালাটি আবার চালু হয়। ৩টি ইউনিটকে এখানে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ১৯৫০ সালে এখানে একটি ফ্লাইং স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ১৯৬২ সালের দিকে সেটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এখনো এখানে হেলিকপ্টার ফ্লাইং এর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১ম এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের বহু ধ্বংসপ্রাপ্ত উড়োজাহাজ এর মহাসমারোহ দেখা যায় এখানে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখন এটিকে যাদুঘর বানানোর পরিকল্পনা করছে।
এইসব বিমানশালার অতীত ও বর্তমান নিয়ে গবেষণা করলে যে বিষয়টা সামনে আসে তা হলো, এই ভাঙ্গা,অকেজো বিমানগুলো ইতিহাসের সাক্ষী এবং সরকার সেগুলো সংরক্ষণ করছে। এগুলো হয়তো ভেঙ্গে ফেলে কিংবা পুনরায় ব্যবহার যোগ্য করে তুলে অন্যান্য কাজ লাগানো যেত, কিন্তু এগুলো যে ইতিহাস বয়ে বেড়ায় তা হয়তো চিরতরে হারিয়ে যেত। তাই এই ধ্বংসস্তূপগুলোর আখড়ার পাশেই যাদুঘর গড়ে এগুলোকে চিরস্থায়ী করার প্রচেষ্টা আসলেই প্রশংসনীয়।