পৌরানিক জিনিষের প্রতি মানুষের সবসময়ই একটি আকর্ষণ কাজ করে। ড্রাগন, ডাইনোসরের মতো বর্তমানে বিলুপ্ত থাকা প্রাণীগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহের কমতি নেই। তেমনই এক প্রাণী শিংঅলা ঘোড়া যা ইউনিকর্ণ নামে পরিচিত। ধবধবে সাদা শরীরের এই ঘোড়াকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বাস্তবেই কি এই ঘোড়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়?
শিংঅলা ঘোড়া দেখতে বেশ আকর্ষণীয়। ধবধবে সাদা শরীর। মুখমণ্ডল লাল ও চোখদুটো নীল। ঘোড়াটির লেজ সিংহের মতো এবং ক্ষীপ্রতা ছিলো অসম্ভব। চোখের পলকেই এটি ছুটে বেড়াতো অরণ্য-প্রান্তর, পাহাড়-পর্বত সবখানে। তার সুন্দর একরাশ কেশর ফুলে-ফেঁপে উঠত সাগরের ঢেউয়ের মতো। শিংটা গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত সাদা, কালো ও লাল রঙের ছিলো। ক্ষুরও ছিলো তীক্ষ, বুনো হাতিও তার কাছে হার মানতো। তবে এই প্রাণীটির দুর্বলতা ছিলো কুমারী মেয়ে। কোনও কুমারী মেয়ে দেখলেই তার পায়ের কাছে বা কোলে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াতো এই একশিংঅলা ঘোড়া। হয়ে যেত বেশ নম্র, উদার আর অনুগত। সুন্দরী কুমারীদের প্রতি শিংঅলা ঘোড়ার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ঘোড়াদের বিচরণভূমিতে রেখে আসতো কোনও সুন্দরী কুমারীকে। কুমারীকে দেখেই তার পায়ের কাছে বা কোলে শিশুর মতো আশ্রয় খুঁজত শিংঅলা ঘোড়ারা। তখনই সুযোগ বুঝে ছুটে আসত শিকারি।
বাইবেলে শিংঅলা ঘোড়ার অস্তিত্ব
মেসোপটেমিয়া যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ অব্দ) এমনকি প্রাচীণ গ্রিস, ভারত ও চীনের চিত্রকর্মে শিংঅলা ঘোড়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, বাইবেলে ৯বার শিংঅলা ঘোড়ার কথা রয়েছে, যদিও সেটি নাম ছিলো রিম। আধুনিক খ্রিস্টানরা এই ইউনিকর্ণকে যিশুর প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করে।
ইউনিকর্ণের অস্তিত্ব
মধ্যযুগে এর প্রতি ছিল ইউরোপিয়ানদের অগাধ বিশ্বাস ছিলো বলে জানা যায়। তখনকার সময়ের তৈজসপত্র, রাজকীয় প্রতীক, মুদ্রা ইত্যাদিতে ইউনিকর্নের উপস্থিতি ছিলো ব্যাপক। খাবার কিংবা জলাশয়ের পানি বিশুদ্ধ ও ভালো কিনা সেটি পরীক্ষা করার জন্য তাতে ইউনিকর্ণের শিং ডুবিয়ে রাখার হতো। ইংল্যাণ্ডের রাজবংশে দ্বিতীয় চার্লসের সময়ও পানপাত্রে থাকতো ইউনিকর্ণের মূর্তি। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, সত্যিকারের ইউকির্ণের শিং না পেয়ে মূলত নরহোয়েল নামের তিমির দাঁত এই শিং তৈরি করা হতো। স্কটল্যান্ডে ইউনিকর্ণ ছিল সম্ভ্রান্ততার প্রতীক। সেখানকার মুদ্রাতেও পঞ্চাদশ আর ষোড়শ শতকে ইউনিকর্ণের ছাপ পাওয়া যায়। এখনও ‘ব্রিটিশ রয়েল হেরলডিক আর্মস’-এর অনেকগুলো প্রতীকের একটি হলো ইউনিকর্ণ।
গ্রিস : দ্য গ্রিক হিস্টোরিয়ান টেসিয়াসের এক শিংঅলা প্রাণীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
ভারত : ভারতীয় বিদ্যায় একটি সাদা ঘোড়ার আকার, বেগুনি রঙের মাথা, নীল চোখ, একাধিক রঙের শিং যার নিচে সাদা, মাঝে কালো ও উপরে লাল রঙের উল্লেখ পাওয়া যায়।
চীন : চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াসের জন্মের সময় ইউনিকর্ণের অস্তিত্ব ছিলো বলে জানা যায়।
বিজ্ঞানীরা যা মনে করেন
পণ্ডিতদের লেখায়, শিল্পীদের আঁকায় কিংবা ভাস্করদের ভাস্কর্যে ইউনিকর্ন যতো ফুটে উঠুক না কেন, বাস্তবাদীরা কোনও মতেই ইউনিকর্নের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজী নন। এর কারণও রয়েছে। পৃথিবীর অনেক স্থানে নানা রকম প্রাচীন প্রাণীর কথা জানা গেছে। সেটা ফসিলের মাধ্যমে অথবা প্রতিকৃতির নমুনায়। এখন পর্যন্ত ইউনিকর্নের কিছুই মেলেনি। যদিও ২০১৬ সালে এক শিংঅলা প্রাণীর একটি ফসিল হাড় পাওয়া যায়, যাকে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ান ইউনিকর্ণ নাম দেন। সাড়ে তিন লাখ বছর আগে এই প্রাণীর অস্তিত্ব ছিলো, যার ১৫ ফুট লম্বা, ৬ ফুট উচ্চতার ও ৮ হাজার পাউন্ড ওজনের ছিলো। ফলে দেখতে গন্ডারের মতো প্রাণীই মনে করা হয় এবং এটি সাদা ছিলো না। ফলে এটিকে প্রাচীন ইউনিকর্ণ হিসেবে মানতে নারাজ অনেকেই।
পাওয়া যায়নি, তাহলে তৈরি হোক
ইউনিকর্ণের বাস্তবিক অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ায় থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। জার্মান বিজ্ঞানী অটো ভন গুহায় পাওয়া হাড় থেকে ইউনিকর্ণের কংকাল তৈরি চেষ্টা করেন। এমনকি ১৭০০ সালে প্রকাশিত একটি বাইয়ে স্কেচ প্রকাশ করেন। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ভিডিওতে ইউনিকর্ণকে ফুটিয়ে তুলছেন। এমনকি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে কৃত্রিম অবকাঠামো। ২০০৮ সালে প্রাটো ইউনিকর্ণ নামে একটি এক শিংঅলা হরিণ জন্ম নেয়।
তথ্যসূত্র : বিলিভ ইট অর নট ও উইকিপিডিয়া