সব বাধা পেরিয়ে

হঠাৎ করেই মাথায় এসেছিলো চিন্তাটা। আশপাশের এবং নিজের গ্রামে কোনো পাঠাগার (লাইব্রেরি) নেই । আর তাই এলাকার ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে বই পড়ার সুযোগ থেকে।

যদি একটি পাঠাগার থাকত তাহলে যখন যে বই দরকার সেগুলো পাওয়া যেত হাতের কাছে। স্কুলের সব শ্রেণীর পাঠ্যবইও যদি থাকত সে পাঠাগারে। দরিদ্র শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে বই নিয়েই পড়াশোনা করত। এতে গ্রামের চেহারাটা পাল্টে যেত।

এমন চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো মিশুকের মাথায়। মিশুকের এই ভাবনার সঙ্গে যোগ দেয় গ্রামের আরো কিছু স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে। একটি পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তারা।

টাকা সংগ্রহের জন্য ১৩ জন তরুণ-তরুণী শ্রমিক হিসেবে কয়েক বিঘা জমির ধান কেটে যে টাকা পায় তা দিয়ে তাদের পাঠাগার গড়ার স্বপ্নপূরণের বীজ বোনে।

২০১০ সালের মাঝামাঝি। সবকিছু ঠিকঠাক। ছোট্ট একটি পাঠাগার দিয়েই শুরু করা হবে পথ চলা। নামও ঠিক করা হয় ‘শ্রমকল্যাণ পাবলিক পাঠাগার’। মিশুক তার নিজের বাড়ির একটি ঘর পাঠাগারের জন্য ছেড়ে দেয়।

সেখানেই প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠে এলাকার প্রথম গণ পাঠাগার (পাবলিক লাইব্রেরি)। কিন্তু কিছু বই সংগ্রহ করার পর সেগুলো রাখা নিয়ে সমস্যা শুরু হয়।

হাতে বুকশেলফ বানানোর মতো টাকাও নেই। তবুও চেষ্টা থেমে থাকে না। অনেক চেষ্টার পর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এলাকার মুক্তা আপা। সাইফুন নাহার মুক্তা তাদের সব কথা শোনার পর পাঠাগারের জন্য বেশ কয়েকটি বুকশেলফ বানিয়ে দেন তিনি। সঙ্গে কিছু বইও কিনে দেন।

মুক্তা আপার মতো আরো অনেকেই  পাঠাগারে বই দিয়ে সাহায্য শুরু করেন। নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জের পূর্ব দলিরাম গ্রামের ১৩ তরুণ-তরুণী এভাবেই গড়ে তোলে ‘শ্রমকল্যাণ পাবলিক পাঠাগার’।

মিশুক, রিগান, ইমাম, মিশন, রিমন, রিয়ন, আল-আমিন, মামিম, জাকির, লায়ন, মিলু, সাইফুল, রাকিবের একান্ত প্রচেষ্টায় ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঠাগারটি। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় পাঠাগারের সদস্যরা নিজেদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সভায় বসে।

সবার সম্মতিতে যে কোনো কাজের পরিকল্পনা করা হয়। এছাড়া পাঠাগারের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি খুঁজে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, স্কুলে যাতায়াত, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপাড়া নিশ্চিত, বিনামূল্যে কোচিং, শিক্ষা খরচ বহনের ব্যবস্থাও করে। তরুণ-তরুণীদের প্রচেষ্টায় গ্রামটির সব শিশু এখন স্কুলমুখী।

তাদের উদ্যোগের কারণে গ্রামটিতে এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না, যে বাড়ির শিশুরা এখন স্কুলে যায় না। এছাড়া গ্রামের সব বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, শিশুদের হাত ধোয়া শেখানোর পাশাপাশি অসহায় দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো এবং বাল্যবিবাহ রোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ওরা।

পাঠাগারটির সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম মিশুক জানান, আমরা ১৩ জন শ্রমিক হিসেবে গ্রামে বিভিন্ন জনের জমির ধান কেটে ১৩ হাজার টাকা সংগ্রহ করি। বই কেনার জন্য সাইকেলে করে রংপুরে গিয়ে সংগৃহীত টাকার বই এনে পাঠাগারটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।

পাঠাগারটি উদ্বোধন করেন শিক্ষক ফজলুল হক। সেই থেকে পাঠাগারটি শুরু করে আলোর পথ দেখা।

পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন জানান, শুরুটা ১৩ জন দিয়ে হলেও পাঠাগারে এখন সদস্য ৭০ জনের বেশি। সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ১০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে সঞ্চিত টাকায় পাঠাগার উন্নয়নের কাজ করা হয়।

এছাড়া ঈদে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর মাঝে সেমাই-চিনি দেয়া হয়। লেখাপড়ায় উৎসাহ বাড়াতে গ্রামের কৃতী শিক্ষার্থীদের দেয়া হয় সংবর্ধনা। পাঠাগারের সদস্য রিয়াদ জেরিন শিল্পী জানান, প্রতিদিনই পাঠাগারটি খোলা থাকে।

সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত পাঠাগারের সদস্যরা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কোচিং করায়। নারীদের অগ্রাধিকার দিতে কার্যনির্বাহী কমিটিতে ৪ জন নারী সদস্যকে রাখা হয়েছে।

পাঠাগারের ব্যয়ভারে লেখাপড়ার সুযোগ প্রাপ্ত দরিদ্র ২০ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে। যাদের আমরা সংবর্ধনা দিয়েছি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে।

নিজস্ব জায়গা না থাকা, পাঠাগারে বসার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত বই না থাকা সর্বোপরি আর্থিক সংকটের কারণে পাঠাগারটি এখেনা দাঁড়াতে পারেনি পূর্ণাঙ্গরূপে। গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড সদস্য আনিসুর রহমান জানান, তরুণদের উদ্যোগকে সাদরে গ্রহণ করে একটি পাকা ঘর দিয়েছি।

যেখানে আপাতত পাঠাগারটি নির্ধারিত স্থানে না যাওয়া পর্যন্ত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে। তবে ব্যাপক পরিসরে সহযোগিতার জন্য তিনি বিভিন্নজনের কাছে আহ্বান জানান।

শরীফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী বলেন, তরুণদের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তারা আলোকিত গ্রাম গড়তে যে চেষ্টা করছে নিশ্চয়ই সে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। গ্রামে  ইতিমধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন