ডিসেম্বর। আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালির গৌরবের মাস। পরাধীনতার শেকল ভেঙে মুক্ত হওয়ার মাস। এই বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে মুক্তিকামী বাংলার জনগনকে। শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে নির্ভীক চিত্তে। স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে অানতে বুকের তাজা রক্তে রাঙাতে হয়েছে মাতৃভূমিকে। বিজয়ের মাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানীদের গৌরবগাথার টুকরো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলাে এ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য-
অনারারি ক্যাপ্টেন (অব.)বীর প্রতীক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ভুঁইয়া ১৯৫০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার কসবা থানার অর্ন্তগত টংকি আদর্শ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ আলী আমজাদ ভুঁইয়া এবং মাতার নাম মোছাম্মৎ হামিদা খাতুন। তাজুল ইসলাম ১৯৭০ সালের ২৭ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত ট্রেনিংয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ স্থান লাভ করেন এবং পরবর্তীতে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রমের নেতৃত্বে যশোর সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন এবং যশোর সেনানিবাসের অস্ত্রাগার ভেঙে হাতিয়ার নিয়ে প্রবল বিক্রমে শত্রুসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। পরবর্তীতে জেডফোর্সের অধীনে আরো অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এই বীর সেনা। যুদ্ধকালীন সময়েই তিনি সিপাহী পদ থেকে নায়েক কর্পোরাল পদে উন্নীত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে “বীর প্রতীক” খেতাবে ভূষিত করা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন এবং সিপাহী থেকে অনারারী ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় ভূষিত হয়ে সুদীর্ঘ ৩৩ বছর চাকুরী শেষে ২০০৩ সালের ২৬ জুন সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
……………………………………
২৯ মার্চ সকালে দরবার ডেকে আমাদের বলা হলো যে ভারত ও পাকিস্তান অচিরেই যুদ্ধ লাগছে এবং আজকেই বর্ডারে ওপি (অবজারভেশন পোস্ট) যাবে বর্ডার দেখার জন্য। সুতরাং আমাদের ইউনিট থেকে ওপি এবং রেকি দল যাবে।
একথা জানিয়ে তারা আমাদের ইউনিট থেকে ব্যাটেলিয়নের সমস্ত বুদ্ধিমান সৈনিক যারা হাজির থাকলে সমস্যা হবে তাদেরকে পাঠিয়ে দিল বর্ডারে। তাদেরকে বলা হলো ‘তোমরা বর্ডারে গিয়ে ওপি পোস্টে রেকি করতে থাক। আমরা অচিরেই বর্ডারে প্রতিরক্ষা নিব ভারতের বিরুদ্ধে।’ ভালো ভালো সৈনিকদেরকে পাঠিয়ে দিয়ে বাকি লোকদেরকে বলা হল ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বর্ডারে গিয়ে ডিফেন্স নিতে হবে এবং আজকেই আমাদের ব্যাটেলিয়নে ডিফেন্স লে-আউটও হয়ে যাবে।’
একথা শোনার পর আমরা ভাবলাম ভারতের সাথে যুদ্ধ হলে তো আমরা বসে থাকতে পারিনা। সবাই প্রস্তুত হয়ে গেলাম। কিন্তু প্রস্তুত হওয়ার পরে নানা দ্বিধান্বিত সিদ্ধান্ত হতে লাগলো । একবার হেঁটে যাওয়ার কথা বলা হয় আবার পর মুহূর্তেই গাড়িতে যাবার কথা বলা হয়। এভাবে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। এরপর হঠাৎ অর্ডার হল যে এখান থেকে হেঁটে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যেতে হবে। এখন আর বর্ডার রক্ষা বা যুদ্ধ এসব নিয়ে কোন কথা নেই। আমরা বুঝলাম ইচ্ছে করে তারা নাটক করে সময় পার করে সন্ধ্যা করেছে।
সন্ধ্যার সময় হেঁটে ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার ১ ঘণ্টা পর এমন একটি অবস্থানে আমরা আসলাম যেখানে আমাদের ইপিআর(ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল), মুজাহিদ, আনসার ও পুলিশ সম্মিলিতভাবে পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষা করে রেখেছে। তারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছে যাতে করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে লোক বের হলে ঐদিকে আর যেতে না পারে।
যে মুহূর্তে আমরা ওখানে আসলাম সেই মুহূর্তে মেজর লেয়ার খান অর্ডার দিল যে আমরা দুই-আড়াই মাস ট্রেনিং করে কতটুকু শিখেছি তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটা মহড়া করব। মহড়া অর্থাৎ কৃত্রিম যুদ্ধ হবে। মহড়া করতে হবে সামনে অবস্থানে থাকা ইপিআর, আনসার ও পুলিশদের উপর। তারা সেখানে অস্ত্রসজ্জিত রয়েছে। অর্থাৎ ওদের কাছে লাইভ এ্যামুনেশন আছে। আর আমাদের কাছে কোন এ্যামুনেশন থাকবে না। কিছু এ্যামুনেশান থাকবে যেটাকে আমরা বলি ডেমি রাউন্ড। এর কোন বুলেট নেই শুধু আওয়াজ ও শোলা আছে। এই বলে আমাদেরকে ডিফেন্সের সামনে পজিশনে নিয়ে লাগিয়ে দিল।
আমরা যখন পজিশনে গেলাম ইতোমধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে চারিদিকে । এমন সময় স্থানীয় কিছু লোক এসে কানের কাছে বললো ‘ভাই, এখানে কি হবে?’ বললাম ‘এখানে আমাদের মহড়া হবে’। তারা বললো ‘কিসের মহড়া?’ বললাম ‘আক্রমণ হবে’। তারা জিজ্ঞাসা করলো ‘কোথায়?’ আমি বললাম ‘ওই গ্রামে’ । এটা শুনে তারা বলল, ‘আরে! কি বলেন? ঐখানে তো আমাদের লোক। মুক্তিযোদ্ধারা ওইখানে ডিফেন্স নিয়ে আছে। আপনারা যদি যান তাহলে ওরা সবাই আপনাদেরকে ফায়ার করে মেরে ফেলবে।
আল্লাহ-খোদার দোহাই আপনারা ওখানে এই আক্রমণ বা মহড়াটা করবেন না’। এভাবে বলাবলি করতে করতে একান-ওকান হতে হতে সৈনিকরা সবাই বুঝে গেছে। সৈনিকরা বুঝার পর আমরা বললাম যে আমরা এই মহড়া দিব না। কেন দিব না সেটা বলিনি। অনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করল ‘কেন দিবা না ?’
তখন আমি বললাম ‘সৈনিকরা এক – দুঘণ্টা হেঁটেছে। সামনে আরো দু-আড়াই ঘণ্টা হাঁটতে হবে। সবাই ক্লান্ত। মহড়া করা যাবে না’। কারণ যদি বলি যে মহড়া করব না তাহলে তো ডিনাই (অস্বীকার) হবে। কারণ তখনো পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না যে এটা কি হবে? যদিও পরে ওরাও টের পেয়েছে। পাকিস্তানিরা পাঁচজন অফিসার এবং আমাদের বাঙালি অফিসার মাত্র ৩ জন।
এদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র হলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ, লেফটেন্যান্ট আনোয়ার এবং জেনারেল খাজা ওয়াসি উদ্দিনের ছেলে লেফটেন্যান্ট খাজা সফিউদ্দিন। এদেরতো কোন ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা সব কর্ণেল ও মেজরদের হাতে। মেজর বুঝতে পারল যে এরা যদি এখান থেকেই বিদ্রোহ করে তাহলে তো আমরা পাঁচজন এখানেই শেষ। সুতরাং তারা কথা না বাড়িয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলো ।
ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের পরেই আমরা ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম। মানসিকভাবে আগেই প্রস্তুত ছিলাম। সুতরাং সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকি। ক্যান্টনমেন্টে আসার পরে সামরিক নিয়মেই আমাদেরকে রিপোর্ট করতে হয়। আমরা কি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করেছিলাম আবার আমরা কি নিয়ে ঢুকলাম এটার একটা হিসাব-নিকাশ এবং ওকে রিপোর্ট হয়। এখানে আসার পরে ওকে রিপোর্টের জন্য সবকিছুই হয়েছে কিন্তু রিপোর্টটা নিবে কে!
কেননা যিনি রিপোর্ট নিবেন অর্থাৎ সবার মধ্যে সিনিয়র মেজর লেয়ার খান, তিনি ক্যান্টনমেন্টে ঢুকেই চলে গেছেন মেসে এবং তার সাথে ওই চারজন পাকিস্তানি অফিসারও চলে গেছেন। আমাদের বাঙালি অফিসার ৩ জনই দাঁড়িয়ে আছেন। হাফিজ স্যার অনেকক্ষণ বসে থেকে কোন খোঁজ-খবর না পেয়ে আনোয়ার স্যারকে বললেন ‘আনোয়ার, তুমি থাক’। এই ফাঁকে সফি স্যার চলে গেলেন।আনোয়ার স্যারকে সেখানে রেখে হাফিজ স্যার মেসে গেছেন রিপোর্টটা নিয়ে।
তিনি রিপোর্টটা দেওয়ার পরে লেহার খানকে বললেন ‘স্যার, পরের দিনের কি আদেশ?’ (রিপোর্টের সময়ই বলার নিয়ম)। তখন লেহার খান বললেন‘ পরের দিন সকাল ৭ টার সময় অস্ত্র পরিষ্কার হবে। যেহেতু ট্রেনিংয়ের সময় অস্ত্রে ধুলা-বালি ও ময়লা লেগেছে তাই অস্ত্র পরিষ্কার হবে।’ হাফিজ স্যার ঠিক আছে বলে চলে এসে আমাদের বললেন ‘এখন সবাই অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার ব্যারাকে চলে যাবে। কালকে সকাল ৭ টার সময় অস্ত্র পরিষ্কার করা হবে। তার পূর্বে নিজস্ব যেসব কাজ আছে, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা অর্থাৎ যার যা কাজ সব কাজ সেরে নিবে ৭ টার পূর্বে। ঠিক আছে।’
আমরা ব্যারাকে এসে দেখি যারা ব্যারাকে আছে তাদের মধ্যে একরকম কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম ‘কি হয়েছে?’ তারা বললো ‘আমাদের ব্যাটেলিয়নের চর্তুদিকে তাদের (পাকিস্তানিদের) সৈন্য লে-আউট করানো আছে। যেকোন সময় আমাদের উপর আক্রমণ করতে পারে।’ এটা শুনে ওই রাতেই আমাদের কিছু কিছু লোক গোপনে গিয়ে দেখেছে যে পাকিস্তানিরা কিভাবে আছে এবং বাংকার কিভাবে করেছে। বাংকারগুলোর মুখ আমাদের দিকে নাকি অন্য দিকে?
দেখার পরে আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে কাল সকালে যেকোন সময় হামলা হতে পারে। সেসময় অনেক লোককে দেখলাম যারা নিজের ইচ্ছায় সিভিল কাপড় পরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে । জিজ্ঞেস করলাম ‘কিরে ভাই, কোথায় যাচ্ছো ?’ তারা বললো ‘কালকে তো যুদ্ধ লাগবেই। তাই আর থাকব না।’ এভাবে অনেক লোককে চলে যেতে দেখলাম।
আমাদের প্লাটুনটি বি কোম্পানির ৪ নম্বর প্লাটুন। এসব দেখার পর ল্যান্স নায়েক গফুর আমাদের প্লাটুনের সৈনিকদের একত্র করে বললেন ‘তোমরা যে যেখানেই যাও সকালবেলা প্রথম কাজ হবে তোমরা নিজ নিজ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ঠিক করে অস্ত্র পরিষ্কার করতে যাওয়ার আগে স্টিল হেলমেট, সিলিং(যেটা দিয়ে অস্ত্র ক্যারি করা হয়) এবং অস্ত্রের ডিক্সগুলো রেডি রেখে যাবে। এগুলো হাতের কাছে রাখবে যেন চাইলেই পাও’। আমরা বললাম যে ঠিক আছে। সকালবেলা আমরা চলে গেলাম পান্তাপাড়া পুকুরে কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়ে পরিস্কার করতে।
কিন্তু আমরা যখন সব পরিস্কার করার কাজ করছি ঐ অবস্থায় খবর আসলো যে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছে। যার যা কাপড়-চোপড় ধোয়া হলে হয়েছে বা না হলে নাই। তাড়াতাড়ি ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। আমরা ব্যারাকে চলে এসে দেখলাম গফুর ওস্তাদ ইউনিফর্ম পরা। আগে তাকে পরা দেখে গিয়েছিলাম হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি। কিন্তু এখন তিনি ইউনিফর্ম পরা। আমি তাকে বললাম ‘ওস্তাদ, কী খবর?’ তিনি বললেন ‘তাড়াতাড়ি ড্রেস লাগা’।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে । তিনি বললেন ‘কোয়ার্টার গার্ডের ভেতরে নিরস্ত্র করার জন্য বিগ্রেড কমান্ডার নিজে এসে হাজির হয়েছে’। সেসময় বিগ্রেড কমান্ডার পাকিস্তানি বিগ্রেডিয়ার দুরানী। তখন আমি বললাম ‘ ঠিক আছে’। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বাস্কেট বলের গ্রাউন্ডের কোনায় দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি কি হচ্ছে লক্ষ্য করলাম। কোয়ার্টার গার্ডের ভেতরে দেখলাম যে ব্রিগেডিয়ার দুরানী গিয়ে গার্ড কমান্ডারের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের ব্যাটেলিয়নের যত স্টোর আছে (কোত, অ্যামিনিশন ও ড্যাম) সবগুলোর চাবি একটি বাক্সে থাকে (সে বাক্সের নাম হল চাবি বক্স)। ব্রিগেডিয়ার দুরানীর সেই বক্সের ভেতর থেকে চাবিগুলো নিয়ে আমাদের ব্যাটেলিয়নকে নিরস্ত্র করে যাবে।
যখন তিনি চাবি চেয়েছেন তখন ওখানকার গার্ড কমান্ডার নায়েক ইউনুস ভুঁইয়া চাবি দিতে রাজি হয়নি। রাজি না হওয়ায় তিনি বললেন ‘তুমি চাবি দিবে না কেন?’ নায়েক ইউনুস ভুঁইয়া বললো ‘স্যার, আমি চাবি দিতে পারব না’। এ কথায় রাগান্বিত হয়ে ব্রিগেড কমান্ডার দুরানী বললেন ‘আমি ব্রিগেড কমান্ডার বলছি’। কিন্তু ইউনুস ভুঁইয়া একই দৃঢ়তায় বললো ‘স্যার, ব্রিগেড কমান্ডার চাবির মালিক না’। এ কথায় তিনি আরও রাগান্বিত হয়ে বললেন ‘চাবির মালিক কে?’
ইউনুস ভুঁইয়া জবাব দিল ‘সুবেদার মেজর’। পরে তিনি সুবেদার মেজরকে বাসা থেকে আনিয়েছেন। সুবেদার মেজরও নন বেঙ্গলী বিহারি। সে এসে বললো ‘ইউনুস, তুমি চাবি দিয়ে দাও’। তখন ইউনুস ভুঁইয়া আবার বললো ‘আমি এই মুহূর্তে চাবি দিতে পারবনা। কারণ দেশের পরিস্থিতি ভালো না’। সে বললো ‘আমি সুবেদার মেজর, আমি চাবি চাচ্ছি।’ ইউনুস ভুঁইয়া দৃঢ়তার সাথে বললো ‘না, আমি আপনাকেও চাবি দিতে পারব না’।
তখন সুবেদার মেজর আজিম খান ওই চাবির বক্সের গ্লাসটায় ঘুষি মেরে গ্লাসটা ভেঙে ফেলল। ভাঙার পর চাবি নিয়ে যখন টান দিয়েছে তখন তার মুখের মধ্যে নায়েক ইউনুস ভুঁইয়া ঘুষি মেরেছে। এতে করে সুবেদার আজিম খানের মুখের খানিকটা জায়গা কেটে যায় এবং দাঁতও নড়ে যায়। সুবেদার মেজর এবং নায়েক ইউনুসের এই দস্তাদস্তির মধ্যেই ব্রিগেড কমান্ডার 'কী বক্সে' হাত ঢুকিয়ে চাবি বের করে দ্রত পদক্ষেপে জীপে উঠে তার স্কটসহ মুভ করে চলে গেলেন।
এদিকে আমাদের নূর মোহাম্মেদ নামে একজন সিপাহী আছেন। সে জিডি ক্লার্ক। অর্থাৎ অফিসে কাজ করে। সে অফিস থেকে দৌড়ে এসে বলছে ‘সিও সাবকে এ্যারেস্ট করে ফেলেছে’। কে এ্যারেস্ট করেছে জানতে চাইলে সে বললো ‘টুআইসি সাব এবং এখন তিনি টু আইস সাবের সামনে বসা। তার ক্যাপও কেড়ে নিয়েছে’।
নূর মোহাম্মদ যখন এ খবর জানালো তখন আমাদের কোম্পানির সামনে আর্টিলারী রেজিমেন্টের ৩ জন জেসিও (জুনিয়র কমিশন অফিসার), ২ জন সুবেদার, একজন নায়েক সুবেদার বসে গল্প করছে এবং চা খাচ্ছে। আমরা বললাম ‘সিওকে যখন এ্যারেস্ট করে ফেলেছে এখন আর আমাদের বসে থেকে লাভ নেই। এই তিনটারে ধর, এই তিনটারে আগে জবাই করি’। এই বলে আমরা চার-পাঁচজন যারা এগিয়ে গেলাম। ওখানে আমাদের জেসিও যারা ছিলেন তারা বললেন ‘না, এটা হয়না। ওরা আমাদের মেহমান এসেছে। কি হয় না হয় ওটা পরে হবে’। এই বলে তারা আমাদেরকে থামিয়ে দিলো। এই ফাঁকে তারা চলে গেছে। ফলে এই সুযোগটা আমরা হারালাম।
ব্রিগেডিয়ার দুরানী চলে যাওয়ার পর বিএইচএম মতলব দৌড়ে এসে বললো ‘ অবস্থা খুব খারাপ। সিও এ্যারেস্ট’। আমরা বললাম ‘এখন আমরা কি করব ?’ উত্তরে মতলব বললেন ‘এখন কি করব? একথা তো এখন আমরা বলতে পারব না। সিওকে জিজ্ঞেস করার দরকার আছে’। তখন আমরা চার-পাঁচজন সিও সাবের অফিসের পেছনের জানালা ছিল ওখান দিয়ে তাকে ডাকছি। সিও লে. কর্ণেল রেজাউল জলিল সাহেব আমাদের ডাক শুনে ঘাড়টা ঘুরালেন ।
আমরা বললাম ‘স্যার আমরা কি করবো এখন?” তিনি তখন বললেন ‘দেখো, আমার করার কিছু নাই। তোমরা যা ভালো মনে কর তাই কর’। এরপর বিএইচএম মতলব বললেন ‘কোতের তালা ভেঙে অস্ত্র নাও। আর অপেক্ষা করা যায়না’। এটা শুনার সাথে সাথে ওখান থেকে আমি সোজা দৌড় দিলাম আমাদের কোম্পানির স্টোরের দিকে। কারণ ওখান থেকে হেমার (হাতুড়ি) নিতে হবে তালা ভাঙার জন্য। আমি দৌড়ে গিয়ে হেমার নিলাম।
কোয়ার্টার মাস্টার ছিল হাবিলদার খলিল আমার হাতে চেপে ধরে বললো ‘ তুই রেজিষ্টারে নাম লিখে নিয়ে যা’। আমি বললাম ‘দেশে যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে। আর আপনি বসে আছেন রেজিস্ট্রার নিয়া। আর এই হেমার আপনাকে আমি ফেরত দিব? আপনার যদি কপাল ভালো হয় তো আমার সাথে চলুন’। এটা শুনে সে উল্টো আমাকে একটু ধমক দিয়ে বললো ‘এই, তুই কী বলিস, কিসের যুদ্ধ? একটু পরেই তো ঠিক হয়ে যাবে। আর্মির মধ্যে কোনদিন এরকম হয় নাকি ?’ ‘আপনি ধমক নিয়ে বসে থাকেন’ এই বলে আমি হেমার এবং একটা ছোট বেলচা নিয়ে দৌড়ে কোয়ার্টার গার্ডে গেলাম। কোয়ার্টার গার্ডে যাওয়ার সাথে সাথে নায়েক ইউনুস ভুঁইয়া আমাকে বললো ‘এই তাজুল, আগে বি কোম্পানির কোতের তালা ভাঙ। বি কোম্পানির কোতের ভেতরে আমি রাতে এ্যামুনেশন ফিলিং করে রেখেছি।
মেগজিনে এ্যামুনেশন ফিলিং করে রাখছি।’ ভাঙলাম ওটা। ভেঙে আমার নামে যে অস্ত্রটা ছিল বি কোম্পানির ১৯ নম্বর এলএমজি (লাইট মেশিনগান) সেটা নিলাম। আর পাঁচটা বেলবক্স ভর্তি এ্যামুনেশন । রাতে ভরে রেখেছিল। ওগুলো আমি টান দিয়ে নিয়ে হেমারটা বাইরে দিয়ে বললাম ‘বাকি কোত যা আছে সব ভাঙ’। এরপরে অন্যরা এই হেমারটা নিয়ে কাজে লাগিয়ে এবং পাশাপাশি যে যেভাবে পেরেছে ইট, পাটকেল দিয়ে কোত ভেঙে অস্ত্র নিল।
কোয়ার্টার গার্ডের বামপাশে একটি বড় বটগাছ আছে। অস্ত্র নেবার পর আমি এটির পাশে গিয়ে পজিশন নিলাম। পজিশন নেয়ার সাথে সাথে আর্টিলারি এবং মর্টার শেল আসা শুরু হয়ে গেছে। আমাদের কোয়ার্টার গার্ডের গোলা পড়ছে। আমাদের একটা শেড ছিল ওখানে, পেছনে এ্যামবুলেন্স ব্যাটেলিয়ন এবং পোস্ট অফিসে আর সিনেমা হলের ছাদের উপরেও সমানে গোলা পড়ছে। এরা আগেই পরিকল্পনা করে আমাদের কোয়ার্টার গার্ড, কোয়ার্টার গার্ডের পাশের রাস্তার যাতে ফায়ার করা যায় সেজন্য বালির থলে দিয়ে আরো উঁচু করে বাংকার করে এইচএমজি ফিট করে রেখেছে। ওখান থেকেও ফায়ার আসছে।
এসব দেখে আমি আমার এলএমজি দিয়ে বটগাছের পাশ থেকে ফায়ার করা শুরু করলাম। কিন্তু এলএমজির ফায়ার কখনো এইচএমজির ফায়ারকে দমন করতে পারে না। কারণ ওটার শক্তি অনেক বেশি। আমি বটগাছের ডানপাশে অবস্থানে আছি। হঠাৎ দেখি আমার বামপাশে নায়েক রবিউল এবং সিপাহী সামাদ একটা এইচএমজি নিয়ে বের হয়েছে। তারা বের হওয়ার সাথে সাথে আমি বললাম ‘রবি ওস্তাদ, আপনি এইচএমজি দিয়ে সিনেমা হলের উপরে ফায়ার দেন’।
সে বললো ‘ ঠিক আছে। আমিও দিচ্ছি, তুইও দে’। আমরা দুজন ক্রসং ফায়ার দেওয়ায় পাকিস্তানিদের ফায়ারটা একটু দমে গেল। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম এখন তো আর এখানে থাকা যাবেনা। ইতিমধ্যে আমার দুই ম্যাগাজিন চলে গেছে। আর আছে ৩ ম্যাগাজিন। আমরা মনে করেছি যুদ্ধ লেগেছে অল্প সময়ের জন্য । হয়ত দুই/ তিন ঘণ্টা পরে শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আমরা দৌড় দিলাম। কোয়ার্টার গার্ডের সামনে গিয়ে দেখি আমার ব্যাচমেট সিপাহী আবুল বাশার। আমরা একই সাথে ট্রেনিং করেছি এবং একই সাথে ইউনিটে পোস্টিং পেয়েছি।
সে একরকম হাঁ করে আছে। কপাল থেকে একটু একটু করে রক্ত পড়ছে। হতবিহ্বল হয়ে আমি ডাকছি ‘এই, বাশার। কি হয়েছে ? কি হয়েছে?’ সে কথা বলতে পারছে না। ওর পেছনে গিয়ে দেখি মাথার পেছনের অংশটা নেই। কপাল দিয়ে গুলি ঢুকে মাথার পেছনে যে কাভারটা থাকে সেটাসহ উঠে চলে গেছে। সে আর কথা বলবে কি! সে আমার দিকে তাকিয়েই রয়েছে।
এখান থেকে দৌড় দিয়ে গিয়ে ম্যাগাজিন ঢুকলাম। কারণ ইতিমধ্যে এ্যামুনেশন শেষ হয়ে গেছে। এ্যামুনেশন লাগবে। ওখানে যাওয়ার পর আমার খুব কাছের বন্ধু আফসার আলী মন্ডলকে পেলাম। সে আমাকে বলছে ‘দোস্ত, আমি তোমার টু (সাহায্যকারী)’ । তাকে বললাম ‘ঠিক আছে’। ওখান থেকে আমরা দুজনে গিয়ে দুটি এ্যামুনেশনের বাক্স নিলাম। তখন সে বললো ‘চল, আমরা আগে মেইন অফিসে যাই’। এ্যামবুলেন্স ব্যাটেলিয়নের ভিতর দিয়ে মেইন অফিসে রওয়ানা দিলাম।
সেখানে পাঞ্জাবী পাঠানরা আমাদের তুলনায় বেশি। আমরা বাঙালি কম। ওখানে যেতেই পাঞ্জাবীরা আমাকে ধরতে আসছে। যদিও তাদের হাতে অস্ত্র নেই। তারপরও ধরতে আসছে। বারান্দায় দেখি যে তারা প্রায় ১৫/১৬ জন লোক। আমি প্রথমে লক্ষ্য করলাম বাঙালি আছে কিনা। দেখলাম বাঙালি কেউ নাই। আমাকে দেখিয়ে ওদের লোকদেরকে বলছে ‘ধর, পাকড়াও, পাকড়াও, পাকড়াও’। আমি বললাম ‘ঠিক আছে। পাকড়ান’। উল্টো আমরাই ওদেরকে ব্যারেল ঘুরিয়ে মেরে ফেললাম। এই প্রথম আমার অপারেশন।
একসাথে সবগুলোকে গুলি করে ফেলেছি।
এরপর গেলাম পোস্ট অফিসে। সেখানে গিয়ে পেলাম আমার প্লাটুন হাবিলদার হালিমকে যাকে বর্ডারে পাঠিয়েছিল ওপি পোস্টে। যদিও সে রাতের মধ্যেই ওখান থেকে চলে এসেছে কিন্তু আমরা তার আসার খবর জানতে পারিনি। তাকে পেয়ে আমার সাহস একটু বাড়ল। আমাদের দুজনের বাড়ি একই থানায়। আমাকে পেয়ে সেও বলেছে ‘তুই আমার সাথে থাক’। আমি বললাম ‘ ঠিক আছে। আমরা আর একটু এগিয়ে নায়েক শরাফতকে পেলাম। এছাড়াও আমাদের সাথে আরও আছে আফসার। আমরা এই চারজনেই পরিকল্পনা করেছি অফিসে গিয়ে যে কয়েকজন নন বেঙ্গলী আছে সবগুলোকে শেষ করে ফেলব। ওখানে তো ১৫/ ১৬ জন শেষই হয়েছে।
এখন অফিসের বাকি নন বেঙ্গলীদের মেরে ফেললে অন্তত ব্যাটেলিয়নটা শান্ত হয়ে যাবে। অফিসে গিয়ে পেলাম ক্যাপ্টেন নেসার, ক্যাপ্টেন আকরাম, লেফটেন্যান্ট নুজির এবং মেজর কোরাইশিকে। মেজর কোরাইশি টুআইসি। এই চারজনকে ধরে অফিস থেকে বের করে পান্তাপাড়ার দিকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছি। তখন সেই সুবেদার মেজর এসে হাতে-পায়ে ধরা শুরু করল। সে তো ওদের পক্ষের বিহারী। সে আমাদের কাছে এসে উর্দুতে বলছে ‘দেখ, আমরা একই ইউনিটের অফিসার। কোন কিছু করোনা। সব কিছু শান্ত হয়ে যাবে। হয়ত আজকে একটু গন্ডগোল হয়েছে। নিজের অফিসার মেরে ক্ষতি করে লাভ আছে ?’ বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে টেনে তাদেরকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। সুতরাং পারলাম না এদেরকে মারতে।
তাদেরকে ছেড়ে পান্তাপাড়ায় গেলাম । ওখানে আমাদের ব্যাটেলিয়নের নিরাপত্তার জন্য পাকা বাংকার করা হয়েছে যাতে কোন দূঘর্টনা ঘটলে আমরা ওই বাংকারে গিয়ে অবস্থান নিতে পারি। ওখানে আমরা অবস্থান নিয়ে বিকাল চারটা পর্যন্ত যুদ্ধ করলাম এবং ওই সময়ের মধ্যে তাদেরকে আমাদের ব্যাটেলিয়নের মধ্যে ঢুকতে দেইনি। ওখানে ওদের ২৫ বেলুচ, ২৭ বেলুচ, এফএফ, আর্টিলারীসহ আরো অনেক সৈনিক আছে। এরই মধ্যে আমাদের এ্যামুনেশন শেষ হয়ে গেছে। তখন আবার অর্ডার হল। ইতিমধ্যে সফি সাহেব কোথায় গেছে তার খবর নেই।
আনোয়ার সাহেব ও হাফিজ সাহেব দুজন আমাদের সাথেই আছেন। হাফিজ সাহেব আমাদের একটি গ্রুপের কমান্ডার এবং আনোয়ার সাব ডানপাশের অারেকটি গ্রুপের কমান্ডার। প্ল্যান হল আনোয়ার সাহেবের গ্রুপ ফায়ার করবে এবং হাফিজ সাহেবের গ্রুপ এগিয়ে যাবে। আবার হাফিজ সাহেবের গ্রুপ যখন ফায়ার করবে তখন আনোয়ার সাহেবের গ্রুপ এগিয়ে যাবে। টার্গেট হল আমরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে কাছের ক্ষিতিকদিয়া নামক গ্রামে গিয়ে একত্র হব। এভাবেই আমরা ফায়ারের মধ্যে চলতে চলতে ক্ষিতিকদিয়া গ্রামে পৌছে যাই। ওই মুহূর্তে খবর আসে যে লেফটেন্যান্ট আনোয়ার সাহেবের গুলি লেগেছে।
এ খবর শুনে হাফিজ সাহেব বললেন ‘আমি যাব আনোয়ারকে আনতে’। হাফিজ সাব ৮/১০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে গেলেন তাকে আনতে। কিন্তু গিয়ে দেখেন যে তিনি ততক্ষণে শহীদ হয়ে গেছেন। তিনি শহীদ হওয়ায় হাফিজ সাহেব তার বেল্টটা খুলে এনেছে। আর কিছু আনেননি । শুধু রক্তমাখা বেল্টটা নিয়ে এসেছে। এই রক্তমাখা বেল্টটা নিয়েই আমরা যারা ওখানে ছিলাম তারা চৌগাছা বাজারে রাত ১১টার সময় একত্র হয়েছিলাম। সকলেই আবেগে আপ্লুত আমরা। সেই বেল্ট নিয়ে আমাদের সবাইকে হাফিজ সাহেব শপথ গ্রহণ করিয়েছের এবং বলেছেন ‘আনোয়ারের এই রক্তের বিনিময়ে আমরা এই দেশ স্বাধীন করব এবং তার রক্ত বৃথা যেতে দেবনা’। আমরা শপথ করলাম যে আনোয়ার সাহেব যেভাবে রক্ত দিয়েছেন সেভাবে আমরাও রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করব।
(সূত্র : '৭১ বীরত্ব বীরগাথা বিজয়'- বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে সংগৃহীত)