গান, সুর, তাল… এক অন্য জগতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই জিনিসগুলো। আর এই অপার্থিব জিনিসগুলোকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাবার পেছনে যে ক’জন মানুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে বেথোভেন একজন।
তাকে যেমনি সুরস্রষ্টা বলা যায়, তেমনি বলা যায় হাজারো গানপ্রেমী মানুষের স্বপ্নের দ্রষ্টাও।
লুডউইগ ভ্যান বেথোভেন একজন জার্মান সুরকার এবং পিয়ানোবাদক। তাঁকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সুরকারদের একজন মনে করা হয়। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ক্লাসিক্যাল ও রোমান্টিক যুগের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাঁর খ্যাতি ও প্রতিভা পরবর্তী প্রজন্মের সুরকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও শ্রোতাদের অনুপ্রাণিত করেছে অনেকাংশে।
বেথোভেনের জন্ম জার্মানির বন শহরে। তরুণ বয়সে তিনি সেখান থেকে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় চলে যান এবং সেখানেই বাকী জীবন কাটান। এখানে তিনি ইয়োসেফ হেইডেন-এর অধীনে দীক্ষা নেন এবং শিঘ্রই অসামান্য কৌশলী পিয়ানোবাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তবে অত্যন্ত কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে যে বয়স মাত্র ত্রিশ ছোঁয়ার আগেই তিনি ধীরে ধীরে তাঁর শ্রবণশক্তি হারাতে থাকেন। কিন্তু এই ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মাঝেও তিনি বিশ্বকে বহুদিন ধরে অসাধারণ সব ‘মাস্টারপিস’ উপহার দিয়ে যান।
মাত্র ১২ বছর বয়সে পিয়ানোতে তাঁর C-minor বাজানো মুগ্ধ করে তোলে আশপাশের সবাইকে।
বেথোভেনের পিতাই ছিলেন তাঁর প্রথম শিক্ষক। আস্তে আস্তে স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষকের কাছে পর্যায়ক্রমে সঙ্গীতের চর্চা করেন তিনি। তবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান গোটলেব নেইফ; বেথোভেনের প্রথম কম্পোজিশনের হাতে খড়ি তাঁর হাত ধরেই। দু’ সপ্তাহের জন্য মোজার্টের কাছে সংগীত অধ্যয়নও করেন তিনি। ১৭৯৮-১৮০০ সালের এই সীমিত পরিসরেই বেথোভেন পরিণত শিল্পী হয়ে যায়। মোজার্ট, হেইডেন এর মত নামী শিল্পীদের আনাগোনা বেথোভেনকে অনেক প্রভাবিত করে। এতকিছুর পরেও নিজের প্রতিভা এবং সৃষ্টিশৈলী তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে।
১৮০০ শতকের শেষের দিকে বেথোভেনের সঙ্গীতের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে তাঁর ভক্ত সংখ্যাও। তিনি ছিলেন ঐ সময়ের “ফ্রী-ল্যান্স” সুরকারদের মধ্যে বিখ্যাত একজন। তাঁর সমসাময়িক অনেক শিল্পী বিভিন্ন গীর্জা বা রাজপ্রাসাদে ভাড়ায় গান গাইতো, কিন্তু সেরকম গৃহবন্দী হয়ে থাকার চেয়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কনসার্ট পরিচালনা করা, প্রকাশক ধরে ধরে বিভিন্ন সুর বিক্রি করে চলতেন তিনি।
আনুমানিক ১৭৯৮ সালের দিকে কোনো এক অজানা কারণে বেথোভেন তাঁর শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলে, কারন হিসেবে বলা হয়েছে ঘুম তাড়ানোর জন্যে ঠান্ডা পানিতে মাথা চুবিয়ে রাখার অভ্যাসের কারণে তাঁর এই পরিণতি হয়েছে।
বেথোভেনের কালজয়ী ‘সিম্ফনী নাম্বার ৯’ তাকে যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রাখসে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। এটি ছাড়াও “পিয়ানো সোনাটা, রাইমস অভ এথেন্স, এন্থ্যাম অফ ইউরোপ, ওয়েলিংটন্স ভিক্টোরি” ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত কিছু সৃষ্টি।
তাঁর রেখে যাওয়া সুরগুলোর অনুকরনে “দ্যা বিটলস” এর মত বিশ্বকাঁপানো ব্যান্ডের হাতেখড়ি হয়েছে।
১৭৭০ সালে জন্ম নেয়া এই সুরস্রষ্টা ৫৬ বছর বয়সে ১৮২৬ সালে মারা যান। কিন্তু বেথোভেন শুধু কোনো নির্দিস্ট সময়ের নন, তিনি এসেছেন চিরকাল থাকার জন্যে। তাঁর এই অমরত্বই সঙ্গীতকে নিয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের অলিন্দ থেকে অলিন্দে, নিলয় থেকে নিলয়ে।