পাতাটির গা আজ কেমন জানি শিরশির করছে। কাতুকুতু লাগছে। নরম নরম লাগছে। এমন অদ্ভুত অনুভূতি আগে কখনো হয়নি পাতাটির। মানুষের পায়ের তলা এতো সুন্দর হয়। এতো মসৃণ, নরম হয়! পাতাটি আগে জানতো না। ভেবেও দেখেনি কখনো।
আর ভাববেই বা কখন। পাতাটি এতোদিন ছিল গাছের মগডালে। ডালের সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে। তখন সে কী দোলা! বাতাসের দোলা। বৃষ্টির পানির দোলা। পাখির নরম পালকের দোলা।
সবুজ সবুজ পাতাগুলোর সঙ্গে তখন তার কতো খেলা। কতো খুনসুটি। কতো আনন্দ। কতো কষ্ট। আনন্দ, দুঃখ, কষ্টের ভাগাভাগি। কিন্তু আজ এসবের কিছুই নেই। চারদিকে শুধু ছায়া। শুকনা পাতার ঝনঝনানি। আর মানুষের শরীরের ভারের কষ্ট। পায়ের জুতার ভারের কষ্ট।
এতোটা ভার সওয়া যায়? মানুষ যখন পাতাটি দলে যায় তখন কষ্ট হয় ভীষণ। জুতাগুলো কী দিয়ে যে বানায় ওরা! ভাবে- পড়ে থাকে পাতাটি। ভাততে ভাবতে প্রতিদিন সকাল হয়। প্রতিদিন দুপুর হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে হয় রাত। প্রতিদিনই এমন হয়।
কিন্তু আজকের সকালটি কেমন জানি অন্যরকম। ভেজা ভেজা। নরম নরম। সূর্যের আলোও অনেক উজ্জ্বল। চারপাশের মানুষগুলো কতো শান্ত। মানুষের পাগুলো যেন আরো শান্ত, নিশ্চুপ। ধীরে ধীরে হেঁটে যাওয়া। শত শ্রদ্ধায় হেঁটে যাওয়া।
প্রকৃতি গায়ে যেন কোনো আঘাত না লাগে এমন করে হেঁটে যাওয়া। সবাই আজ কোথায় যে হেঁটে যাচ্ছে। খালি পা। হাতে ফুল। কোথায় যাচ্ছে মানুষগুলো? পাতাটির ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। কোনো একটি শিশুর হাত ধরে টানতে ইচ্ছে করে। শিশুরা কী সুন্দর। তাদের পায়ের তলাটি আরো সুন্দর। নরম নরম। বিড়ালের গায়ের মতো। হাঁস ছানার মতো। ফুলের পাপড়ির মতো।
পড়ে থাকা পাতাটির আজ ভীষণ ফুল হতে ইচ্ছে করে। মানুষের দুই হাতের তালুতে শুয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে আজ এতো মানুষ যাচ্ছে। দল বেঁধে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে মানুষগুলো? কোথায় যাচ্ছে শিশুগুলো?
ভাবতে ভাবতে একটি শিশুর পা জড়িয়ে ধরে পড়ে থাকা শুকনা পাতাটি। বলে, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? সবাই খালি পায়ে, ফুল হাতে। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের সঙ্গে নেবে আমায়?
পাতার এই কথা শুনে শিশুটি হেসে ওঠে। বলে, তুমি কী বোকা। তুমি তো ফুল নও। আজ শুধু ফুল হাতে নেয়ার দিন। শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার দিন। তুমি জানো না আজ একুশে ফেব্রুয়ারি? আজ আমাদের শহীদ দিবস।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা করার দাবিতে অনেকে শহীদ হয়েছিল। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল ঢাকার রাজপথে। তাদের রক্তের বিনিময়েই আজ আমি তোমার সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি।
তাদের কথা স্মরণে আমরা আজ খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাচ্ছি। মিনার চূড়ে উঠে ফুল দিতে যাচ্ছি। এ কথা শুনে পাতাটি বলে, আমি তোমার সঙ্গে যাব। তোমার সঙ্গে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাব।
পাতার এই কথা শুনে শিশুটি অবাক হয়। বলে, তুমি যাবে আমার সঙ্গে শহীদ মিনারে যাবে? তাহলে চলো, এখনই চলো। দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। এই কথা বলে শিশুটি পাতাটিকে হাতে তুলে নেয়।
পাতাটি ফুলের ঠিক পাশাপাশি বসে। বসে উশখুশ করতে থাকে। তরতাজা ফুলের পাশে নিজেকে ভীষণ বেমানান মনে হয়। তারপরও ভাবে- আমি তো শহীদ মিনারে যাচ্ছি। ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছি।
ফুলের গন্ধ নিতে নিতে পাতাটি শহীদ মিনারের দিকে যেতে থাকে। একসময় তারা শহীদ মিনারে পৌঁছে যায়। শিশুটি বলে, এই আমাদের শহীদ মিনার। পাতাটি ঘড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে থাকে।
মিনারের চারদিকে এতো মানুষ! এতো ফুল! আবাক হয় পাতাটি। দেখে শত শত মানুষ মাথা নিচু করে শহীদ মিনারের বেদির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সবার পা খালি। সবার মুখে গান। সবার হাতে ফুল।
চারদিকে কতো ফুল। লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, কমলা রঙের ফুল। ফুলের মালা। ফুলের প্রতিটি পাড়িও যেন শ্রদ্ধা জানাচ্ছে ভাষাশহীদের। শহীদের সঙ্গে কথা বলছে। মিনারের বুকরে ওপর বসে কাঁদছে। শহীদ ভাইয়েরা কি শুনতে পাচ্ছে তাদের গান? অনুভব করতে পারছে মানুষের পায়ের উষ্ণতা? ফুলের পাপড়ির নরম ছোঁয়া? চোখের পানির লোনা কষ্ট?
পাতাটির ভীষণ কষ্ট হয়। শিশুটির হাত থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। মিনার বেদিতে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। বেদিতে বুক পেতে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। শহীদের রক্তের উষ্ণতা পেতে ইচ্ছে করে? পাতাটি শিশুটিকে বলে, আমাকে এখনই তোমার হাত থেকে নামিয়ে দাও।
আমি শহীদ মিনারের কাছে যাবে। পাতাটি উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে মিনারের খুব কাছাকাছি চলে যায়। কিন্তু ফুলের কারণে বুক ছোঁয়াতে পারে না মিনার বেদিতে। পাতাটি একটি ফুলকে বলে, বন্ধু তুমি একটু সরে যাও। একটুখানি দূরে সরে যাও।
আমি বেদিতে আমার বুক রাখবো। ভাষাশহীদের শ্রদ্ধা জানাবো। আমি আজই প্রথম শহীদ মিনারে এসেছি। আজই প্রথম এমন সুযোগ পেয়েছি।
পাতার কথা শুনে ফুলটি সরে যায়। পাতাটি মিনার বেদিতে চুমু খায়। ভাষা শহীদের বুকের ধুক ধুক শুনতে চেষ্টা করে। শহীদের রক্তের উষ্ণতা অনুভব করার চেষ্টা করে। একসময় সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে যায়।
পাতাটি আর ফেরে না। শিশুটির কাছে ফেরে না। মাটির কাছে ফেরে না। গাছের কাছে ফেরে না। মিনার বেদি ছুঁয়ে পড়ে থাকে। মিনার বেদিতে ঘুমিয়ে থাকে। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া শহীদ ভাইয়ের পাশে ঘুমিয়ে থাকে।
লেখক : ইমরুল ইউসুফ
সহপরিচালক, বাংলা একাডেমী