আদিবাসী, গোত্র বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলতে এমন এক ধরণের জাতিকে বোঝায় যারা কোন রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি কিন্তু রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, রীতি ইত্যাদি। সমগ্র পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন দেশে-মহাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে এরকম অসংখ্য গোত্র বা জনগোষ্ঠী। নিজেদের সংস্কৃতি আর রীতিনীতি দিয়ে এরা একটা দেশের সমাজব্যবস্থাকে করে তোলে আরও বৈচিত্রময়। এরকম কিছু জনগোষ্ঠী নিয়েই এই আয়োজন। আজ জানবো ভাইকিংসদের সম্পর্কে।
৮ম শতক থেকে ১১শ শতক সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চলের (ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড) মানুষ সৌভাগ্যের আশায় ঘর ছাড়ে। সমুদ্রকে নির্ভর করে বেঁচে থাকা এসব মানুষকে বলা হতো ভাইকিংস। ভাইকিংস বলতে মূলত সমুদ্রচারী ব্যবসায়ী, যোদ্ধা ও জলদস্যুদের একটি দলকে বোঝায়। এদেরকে নর্সম্যান বা নর্থম্যানও বলা হয়।
ভাইকিং শব্দটাও এসেছে স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চল থেকে। প্রাচীন নর্স শব্দ ‘ভিক’ অর্থ হচ্ছে উপকূল বা খাঁড়ি। সেটি থেকেই ভাইকিঙর (জলদস্যু) শব্দটি এসেছে এবং তার থেকে ভাইকিং।
ভাইকিংরা আসলে কোন নির্দিষ্ট জাতিসত্ত্বা থেকে উদ্ভব হয়নি। অনেক ধরণের জাতি মিলে পরবর্তীতে ভাইকিংদের জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে নরওয়েজিয়ান, সুইডিশ, ড্যানিশ অনেক জাতির মানুষই ছিল।
ভাইকিংরা খুব আক্রমণাত্মক ছিল। শুরুর দিকে এরা ইউরোপের উত্তর উপকূলীয় এলাকাগুলোতে লুটতরাজ শুরু করে বিশেষ করে ব্রিটিশ উপকূলের যেসব রাজ্যের সুরক্ষা কম ছিল। পরবর্তী ৩০০ বছরে তারা জলদস্যু, ডাকাত আর আক্রমণকারী হিসেবে কুখ্যাতি পায়। সেসময় ব্রিটেনসহ ইউরোপিয়ান উপকূল, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ডে ভাইকিংদের দৌরাত্ব ছিল সাংঘাতিক।
৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের উত্তরপূর্ব উপকূলের লিন্ডিস্ফার্নে মোনাস্ট্রিতে আক্রমণের মাধ্যমে ভাইকিংদের উত্থান ঘটে। একে একে তারা বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে আক্রমণ ও লুট করতে থাকে। ইউরোপের এক বিরাট এলাকা জুড়ে লুটতরাজ চালায় ও বসতি স্থাপন করে। ভাইকিংরা পূর্ব দিকে রাশিয়া ও কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল
নবম শতকে আইসল্যান্ডে ভাইকিংরা প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা আরও পশ্চিমে সরে গিয়ে ১০ম শতকে গ্রিনল্যান্ডে বসবাস ওরা শুরু করে। আইসল্যান্ডের ইতিহাস অনুযায়ী, যারা গ্রিনল্যান্ডে শুরুর দিকে বসতি স্থাপন করেছিল খুব সম্ভবত তারাই প্রথম ইউরোপিয়ান যারা উত্তর আমেরিকা আবিষ্কার করে। ভাইকিংরা জাহাজ নির্মাণে এবং সমুদ্রপথে দিক নির্ণয়ে অত্যন্ত দক্ষ ছিল।
ভাইকিংরা ছিল প্যাগান বা পৌত্তলিক। প্রধান প্রধান ধর্মের কোনটিতেই এরা বিশ্বাস করতো না। ভাইকিংদের নিজস্ব দেব-দেবী ছিল। ওডিন, থর, লকি তাদের কিছু দেবতার নাম। মার্ভেল সুপারহিরো ‘থর’ এর কমিক্স এবং সিনেমা দেখলে এদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়।
ভাইকিংরা দেখতেও বেশ কিম্ভুত ছিল। এরা বিশালদেহী ছিল এবং লম্বা লম্বা দাড়ি-গোঁফ ও চুল রাখতো। বেশীরভাগ ভাইকিংসই মাথায় শিংওয়ালা শিরস্ত্রাণ পড়তো যা এখন ভাইকিংদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তবে অনেকের মতে এগুলো ভাইকিংদের সম্পর্কে ভুল ধারণা।
ভাইকিংদের শৌর্য-বীর্য ছিল ঈর্ষনীয়। সাহসী এবং বীর যোদ্ধা হিসেবে তাদের খ্যাতি ছিল। আইসল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অনেক গাঁথায় ভাইকিংদের শৌর্য-বীর্যের কথা বলা হয়েছে।
খ্রিষ্টধর্ম প্রসারের ফলে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাজ্যগুলো খ্রিষ্টানে পরিণত হয় এবং এর ফলে ভাইকিংদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে খ্রিস্টান সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। ধীরে ধীরে ভাইকিংরাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে স্ক্যান্ডেনেভিয়ার কিছু শব্দ এবং স্থানের নামে ভাইংকিদের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
ভাইকিংদের কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী ও গাঁথা প্রচলিত রয়েছে। ভাইকিংদের উপজীব্য করে হলিউডে ‘হাউ টু ট্রেইন ইউর ড্রাগন’সহ আরও অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ‘ভাইকিং’ নামে একটি আইরিশ-কানাডিয়ান টেলিভিশন সিরিজ রয়েছে যেখানে ভাইকিংদের জীবন ও ইতিহাস সম্পর্কে দেখানো হয়েছে।