বগালেক ও কেওক্রাডং ভ্রমণের কিছু কথা

0
6080

পরীক্ষা শেষ, ব্যবহারিক বাকি আছে অথচ ঘণ্টাখানেক এর পরিকল্পনায় চলে গিয়েছিলাম সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানে। প্রথমেই বলে নেই বান্দরবান বলতে অনেকেই নীলগিরি, নীলাচল, মেঘলা, সাঙ্গু নদী এসবই বোঝে। কিন্তু বান্দরবানের মূল সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে বান্দরবানের ভেতরের দিকে।

এক ভাই বলেছিলো তরুণ বয়সে এসব জায়গা না ঘুরলে পরে আর পারবি না। আপনি যদি পাহাড়ে উঠতে ভয় পান কিংবা পাহাড়ে ওঠার ইচ্ছা বা চেষ্টা না থাকে বা আপনি যদি প্রচুর হাঁটতে না পারেন, আর টানা চৌদ্দ-পনের ঘন্টা জার্নি করতে না পারেন তবে এ জায়গা আপনার জন্য নয়।

কল্যাণপুর থেকে ঢাকা টু বান্দরবানগামী বাসের টিকেট কাটতে পারবেন। শ্যামলী, হানিফ, ডলফিন বিভিন্ন বাস রয়েছে। আমরা শ্যামলী বাসের টিকেট কেটেছিলাম। মূল্য ৬৩০ টাকা। বাস ছাড়বে ১০:১৫-১০:৩০ টায়। ভোর বেলা গিয়ে বান্দরবন শহরে পৌছাবেন। সেখান থেকে অটো নিয়ে যাবেন রুমা বাস স্ট্যান্ড। অটো ভাড়া ১৫ টাকা একজন। ৮টা থেকে রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে রুমা বাজারগামী বাস ছাড়া শুরু করে। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বাস পাওয়া যায়। এক ঘন্টা পরপরই বাস পাবেন। ভাড়া ১১০ টাকা।

তিন ঘণ্টা বা আরেকটু বেশি সময় লাগবে রুমা বাজার পৌছাতে। সেখানে গিয়ে গাইড ভাড়া করতে হবে আপনাকে। গাইড ছাড়া আপনি রুমা বাজার থেকে ভেতরের দিকে যেতে পারবেন না। এটা আর্মি কর্তৃক নির্দেশিত। গাইড আগে থেকে ঠিক করে যাওয়া ভালো। নিচে আমরা যে গাইডকে ঠিক করেছিলাম তার নাম্বার দিয়ে দিবো।

রুমা বাজারে আপনার গ্রুপের প্রত্যেকের বিস্তারিত তথ্য আর্মি ক্যাম্পে লিখে জমা দিয়ে সাইন করে সেখানে ইন হতে হবে। পাঁচটার পর আর বগালেকের উদ্দেশ্যে ইন হওয়া যায় না। এরপর গাইড গাড়ি ভাড়া করবে আপনার জন্য কমলাবাগান যাওয়ার উদ্দেশ্যে। গ্রুপ যত বড় নিবেন ততো আপনার খরচ কম হবে, পাহাড়ে চড়ার সময় ও বড় গ্রুপ হলে মনে সাহস থাকে। গ্রুপ সাত-আটজন পর্যন্ত হলে ল্যান্ড ক্রুজার ভাড়া করা যায়। ভাড়া পড়বে ২০০০ টাকা। আর যদি বড় গ্রুপ হয় তবে চাঁন্দের গাড়ি ভাড়া করা যায়। ভাড়া পড়বে ২৫০০ টাকা।

Boga lake 2
ছবি : লেখক

গাড়িতে কমলাবাগান পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টা বা একটু বেশি। বৃষ্টি হলে গাড়ি ধীরে চলে, সময় বেশি লাগে। কমলা বাজার নেমে আপনাকে লাঠি দেয়া হবে পাহাড়ে ওঠার জন্য। কিনতে হবে আর কি। এরপর বগালেক পাহাড়ে উঠতে হবে যার উচ্চতা প্রায় ১১৭৩ ফুট। চল্লিশ মিনিট লাগার কথা। আমাদের কম লেগেছিলো।

পাহাড়ের ওপর একটা ছবির মতো গ্রাম, তার পাশেই বগালেক। বিশালাকৃতির এই লেক দেখে আপনার এই বিশাল ভ্রমণ স্বার্থক মনে হবে। এখানে ঢুকেই পাশের আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করতে হবে। এই লেকটির সৃষ্টি নিয়ে বেশ কিছু মিথ রয়েছে, স্থানীয়রা বলতে পারবেন। তবে কেউই সঠিক জানেনা কীভাবে এই বিশাল পাহাড়ের খাঁজে এর সৃষ্টি হয়েছে। গভীরতা প্রায় ১৫০-২০০ ফুট এই লেকের।

কটেজ ফাঁকা থাকলে একদম লেকের গা ঘেষে যে তিন-চারটা রয়েছে সেগুলো নিবেন। ব্যালকনি থেকে লেক দেখার অনুভুতিই আলাদা। জনপ্রতি কটেজ ভাড়া ১৫০ টাকা। সেটা যেকজনই হোক না কেন। খাবার ডিম নিলে ১২০ টাকা, মাংস নিলে ১৫০ এই দুটো প্যাকেজ সিস্টেম। খিচুড়ি ডিম নিলে ৮০। প্রচন্ড মিষ্টি পাকা পেঁপে পাবেন, পাবেন গাছ পাকা কলা। ডাবসহ বেশ কিছু ফল। এখানে সারাদিন বিদ্যুৎ থাকেনা। সন্ধ্যার পর সৌর বিদ্যুত পাবেন। যেখানে খাবেন সেখানে ফোন চার্জ দিতে পারবেন। যদিও নেটওয়ার্ক পাবেন না খুব একটা। আর পর্যটক বেশি হলে জেনারেটর চালু করা হয়। এই গ্রামে ৩০টি উপজাতি পরিবার থাকে।

প্রথমদিন লেকের পাড়ে আড্ডা দিয়ে পরদিন খুব ভোরেই রওনা দিতে পারেন কেওক্রাডং এর উদ্দেশ্যে। যেতে আসতে সব মিলিয়ে ঘন্টা পাঁচেক লাগতে পারে। যদিও এটা আপনার হাঁটার ওপর নির্ভর করে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে কেওক্রাডং ৩১৭২ ফিট উপরে। আমাদের যেতে ২ ঘন্টা ৩৩ মিনিট আর নামতে ১ ঘন্টা ১৩ মিনিট লেগেছিলো।

গাইড রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিলো আমাদের সাথে তাল মেলাতে। পথে দুটো ঝর্ণা পাবেন একটার নাম রক হিল, আরেকটা চিংড়ি ঝর্ণা। দুটোই বেশ সুন্দর। দুপুরে কেওক্রাডং এর চূঁড়ায় খেতে হবে। কী খাবেন গাইডকে বলে রাখতে হবে। চাইলে চূড়ার কটেজে রাতটা থেকেও আসতে পারেন। জনপ্রতি ৩০০ টাকা সব কটেজ। ও হ্যাঁ গাইডের থাকা খাওয়ার খরচ সব আপনাকে দিতে হবে। গাইড প্রতিদিন ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা। একটু সমঝোতা করলে ৫০০তে নামতে পারবেন। খাওয়া দাওয়া কিন্তু আলাদা। ব্যাক করার প্রক্রিয়াও একই।

Keokradong
কেওক্রাডং এর চূড়া থেকে অপার সৌন্দর্য্য। ছবি : লেখক

রুমা বাজার এসে আর্মি ক্যাম্পে গাইডসহ আপনাকে রিপোর্ট করে আউট হতে হবে। চারটার পর এই এলাকা থেকে আর্মি আপনাকে আউট হওয়ার অনুমতি দেবেনা। আর বিকেল সাড়ে তিনটার মধ্যে রুমা বাজার না আসতে পারলে বান্দরবনগামী বাস ধরতে পারবেন না। অগত্য তখন আপনাকে চাঁন্দের গাড়ি রিজার্ভ করে চার-পাঁচগুন বেশি ভাড়া গুনতে হবে।

গাইড সম্পর্কিত যেকোন অভিযোগ আপনি রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্পে এসে করতে পারবেন। সত্যতা প্রমাণ হলে তার লাইসেন্স বাতিল হবে। রুমা বাজার থেকে কিছু দূরে রিঝুক ঝর্ণা দেখে আসতে পারেন সময় থাকলে। গরমে পানি থাকেনা।

গরমে না গিয়ে শীতে এই ভ্রমণে যাওয়া ভালো। প্রচুর পর্যটক পাবেন তখন আশেপাশে। বর্ষায় পাহাড়ে চড়া একটু ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা বৃষ্টির ভেতরই গিয়েছিলাম যদিও।

আমাদের গাইডের নাম ছিলো আলমগীর। তার মোবাইল নাম্বার ০১৭৩৯৩৪১১৩৬।

বি.দ্র : এই জায়গাগুলো আপনার আমার দেশের সৌন্দর্য্য। দয়া করে পাহাড়ের ওপর, লেকে, রাস্তায় কোন আবর্জনা ফেলে এই সৌন্দর্য্যকে নষ্ট করবেন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন