জম্মু এবং কাশ্মীরের গ্রেটার অংশটি ভারত, পাকিস্তান ও চীন, এই তিনটি দেশে পড়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ ভারতে পড়েছে। হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম অংশটি কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান ছুঁয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত এই এলাকায় কাশ্মীর ভ্যালিতে ৯৫%, জম্মুতে ৩০% এবং লাদাখে ৪৬% মুসলিম বসবাস করে। মোট জনসংখ্যা ৭.২৫ মিলিয়নের একটু বেশি। এখানে বিভিন্ন সময় হিন্দু, বৌদ্ধ, আফগান, শিখ, মীর ও মুঘলদের শাসন ছিল। ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন শাসনের নিদর্শন এখনও দেখা যায়।
ভৌগোলিকভাবে ভারত এমন এক জায়গায় যেখানে আপনি ভ্রমণের সব ধরণের অভিজ্ঞতা পাবেন। পাহাড়, সমুদ্র, সবুজ সমতল ভূমি, নদী, ঝর্ণা, ওয়াইল্ড লাইফ ও এমনকি মরুভূমিও পাবেন। আবহাওয়ার কথা বিবেচনায়ও অধিকাংশ ঋতু ভারত ও বাংলাদেশে আছে।
সারা বছর কাশ্মীর ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু ভালো সময় হলো মার্চ থেকে অক্টোবর। এ সময়ের মধ্যে দুটি বেশি রোমাঞ্চকর সময় হলো –
১. টিউলিপ ফেস্টিভাল (মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল এর মাঝামাঝি)। এটি আসলে বসন্তকাল। বরফ ও সদ্য সবুজ প্রকৃতির সাথে টিউলিপসহ বেশকিছু ফুল বোনাস।
২. আপেলের সময় (জুন-জুলাই)। এ সময়ে প্রকৃতি পুরো সবুজ রঙ ধারণ করে, সাথে ফুল ও ফলের সমারোহ। এই সময়ে ডাল লেকে কাশ্মীরের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফুল-ফলের ভাসমান বাজার বসে। ম্যাপেল লিফ লাল হয়ে বিছিয়ে থাকে।
পেহেলগামে গল্ফ ও রিভার রাফটিং এর মতো অ্যাক্টিভিটির জন্য এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাস ভালো সময়। এছাড়া মার্চ মাসের আগে কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করলেও ভালো লাগবে, বিশেষভাবে পেহেলগাম, এই সময়ে ভ্রমণ আনন্দদায়ক।
আমরা কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা করি টিউলিপ ফেস্টিভেলকে নিয়ে। আগের বছরে ফুয়াদের অভিজ্ঞতা, ইন্টারনেট ও পরিচিতজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সাত দিনের একটি খসড়া পরিকল্পনা করে ফেলি এবং সেই অনুযায়ী বাজেট এয়ারলাইন্সের বেস্ট রেট অনুযায়ী প্রায় ছয় মাস পূর্বে দুই পরিবারের জন্য টিকিট কেটে ফেলি। আগের বছর ফুয়াদরা কাশ্মীরে ভ্রমণ করেছিল শ্রীনগরের এক যুবকের সহযোগিতায়। ওই লোকের বংশ পরম্পরায় হোটেল ও হাউস-বোটের বিশাল ব্যবসা। প্রায় মাস-তিন আগে তার সাথে যোগাযোগ করে ইমেইলে আমাদের পরিকল্পনাটি পাঠাই। সে আবার আমাদের পরিকল্পনাটি সময়ের সাথে এবং ভ্রমন উপযোগী করে পাঠায়, সাথে সাতদিনের আনুমানিক খরচের একটি বাজেট দিয়ে দেয়।
কিছুটা দরদাম করে ৭দিন ও ছয় রাতের একটি প্যাকেজ ঠিক করি। প্যাকেজের মধ্যে ছিল – ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস, হাউস বোট ও হোটেলে রাতে থাকা, সকাল ও রাতে খাওয়া, এয়ারপোর্ট থেকে পিক করে ড্রপ পর্যন্ত সাত দিনের ড্রাইভার ও ফুয়েলসহ গাড়ি, সব সরকারী ট্যাক্স, পেহেলগামে বিভিন্ন স্পটে ঘুরার গাড়ি, শিকারা চড়া ও পর্যাপ্ত খাবার পানি।
গাইড হিসেবে ড্রাইভারতো ছিলোই, তার বাইরে প্রতিদিন বোনাস হিসেবে ছিলো পরের পুরো দিনের আগাম ব্রীফিং ও গাইডেন্স। বিষয়টি খুবই সহায়ক ছিলো। প্রতিদিনের বর্ণনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উল্লেখ করার চেষ্টা করবো। চারজন প্রাপ্ত-বয়স্ক ও ১২ বছরের নিচে ৪ শিশু নিয়ে ৭ দিনের এই প্যাকেজ পড়েছে ৪৭ হাজার ৬০০ রুপি। আমার ফেইসবুক প্রোফাইলে প্রতিদিনের ছবির অ্যালবাম আছে, দেখে আসতে পারেন।
প্রথম দিন (৩০ মার্চ) – নিশাত গার্ডেন ও টিউলিপ গার্ডেন – কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে বিকেল ৩:০৫-এ শ্রীনগর বিমান বন্দরে পৌঁছাই। ভিনদেশি নাগরিক হলে নামার সাথে সাথে এখানে আপনাকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আপনার পরিচয়, ঠিকানা, হোটেলের ঠিকানাসহ যোগযোগকারীর নাম ও ফোন নম্বর দিতে হয়। এইসব তথ্য হাতের কাছে রাখা ভালো। এখানে অনেক ট্যুর অপারেটর আপনাকে বিভিন্ন অফার দিতে থাকবে (এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা বিদেশীদের সাথে উল্টা-পাল্টা করে)। রেজিস্ট্রেশন শেষে বাইরে আসতেই মনটা জুড়িয়ে গেলো। কলকাতা ও দিল্লির তীব্র গরমের পর বাইরে এসে এখানে প্রশান্তি, কি সুন্দর আবহাওয়া। বাইরে দেখলাম আমাদের নাম লিখা কার্ড নিয়ে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। পরিচয় দিতেই হাঁসিমুখে আমাদেরকে বরণ করে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে আর প্রকৃতি দেখে আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। একটু পর পর আর্মডসহ সৈনিক ও পুলিশ দেখে একটু ভয়ও পেয়েছি প্রথমে। সচরাচর এমন পরিবেশ দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। এয়ারপোর্ট থেকে হাউস-বোটে আসতে প্রায় ৩০মিনিট সময় লাগলো। হাউস-বোটে আসতেই লোকজন এগিয়ে এসে আমাদেরকে নিয়ে গেলো। ওয়েলকাম ড্রিংকসের সাথে কুশল বিনিময়ের পর আমাদেরকে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতে বলা হলো, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। রুমে ঢুকে আমরা অবাক – নৌকায় এতো সুন্দর থাকার ব্যবস্থা। ফ্রেশ হয়ে আসতেই কোথায় যাবো তা ইংরেজিতে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো। হিন্দি বা উর্দু জানা থাকলে ভালো। আমি বুঝতে পারি কিন্তু কোনটাই বলতে পারিনা। ব্রিফিং শেষে ড্রাইভারকে নিয়ে আমরা নিশাত গার্ডেন ও টিউলিপ গার্ডেনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। পথিমধ্যে অবশ্য হালকা খাবার ও পানীয় নিয়ে নিলাম। আমাদের গাড়ি ডাল লেক ঘুরতেই মন ভরে গেল। ড্রাইভার মোজাফফর হিন্দিতে বর্ণনা দিতে থাকলো। গাড়ি নিশাত গার্ডেনে থামলো। মোঘলদের আমলে হওয়া বাগানগুলোর মধ্যে চারটি খুব প্রসিদ্ধ। এটি চারটির মধ্যে একটি। মোবাইলে গাড়ির নম্বর প্লেটের ছবি তুলে নিলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে – কলকাতা থেকে অল-ইন্ডিয়া নামক প্যাকেজের সিম নিয়েছিলাম। সিম বিক্রেতা আমাদেরকে নিশ্চিত করেছিলো যে সিম কাশ্মীরেও চলবে। বাস্তবতা হলো – পোস্টপেইড সিম ছাড়া অন্য কোনো সিম কাশ্মীরে চলেনা। কিছু ট্যুর অপারেটর অবশ্য সিমও দিয়ে থাকে। ড্রাইভার অবশ্য বলেছিলো – সে আমাদের জন্য গেটের সামনেই থাকবে, সে কথা রেখেছিলো। টিকেট কেটে বাগানের ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকেই পাগলের মতো ছবি তুলছি। কিছু লোকজন কাশ্মীরি পোশাকে ছবি তোলার অনুরোধ নিয়ে আসলো। আমাদের ট্যুর অপারেটরের পরামর্শ অনুযায়ী এদেরকে হালকা এড়িয়ে চলতে থাকলাম – কাশ্মীরি পোশাকে ছবি অবশ্য আমরা তুলবো, একটু দাম কমানো আরকি। অবশেষে অর্নামেন্টসহ সাতজনের পোশাক ৩০০ রুপিতে ঠিক করলাম। পোশাক পরে অসংখ্য ছবি তুলেছি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে – আমাদের ক্রিকেটের অনেক প্রশংসাও করলো। পোশাক ছাড়াও অনেক ছবি তুলে সন্ধ্যার একটু আগে পাশের টিউলিপ গার্ডেনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
শ্রীনগরের ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন সম্পর্কে যে বিষয়টি আপনাকে জানতেই হবে সেটি হলো – প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ১৫ থেকে ৩০ দিনের জন্য এই গার্ডেন টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল এর জন্য খোলা থাকে। টিকেটের মূল্য বড়দের ৫০ আর বাচ্চাদের জন্য ২৫ রুপি। টিকিট কেটে টিউলিপ গার্ডেনে ঢুকেই থ। বিশাল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন রঙের টিউলিপ, ড্যাফোডিল ও হাইড্রেনজাসহ শুধু ফুল আর ফুল। একটু পরেই পাহাড়ের কোলে পূর্ণ চাঁদ উঠলো সাথে বিশাল বাগানে সুন্দর লাইটিং। আহা – পৃথিবীর বুকে স্বর্গ বুঝি এখানেই। অনেকে বলে থাকেন কাশ্মীর আসলেন আর টিউলিপ গার্ডেন দেখলেন না – ট্যুর অপূর্ন রয়ে গেলো।
দ্বিতীয় দিন (৩১ মার্চ) – সোনামার্গ – শ্রীনগর থেকে সোনামার্গ-এর দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। খুব সকালে উঠে নাস্তা করে সকাল ৮:৩০ এ সোনামার্গের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলাম। শহর থেকে যত দূরে যাচ্ছি প্রকৃতি দেখে ততই মুগ্ধ হচ্ছি। পাহাড়ের গায়ে বা পাদদেশে সুন্দর সুন্দর ঘর, তার পাশে বয়ে চলেছে ঝর্ণার পানি। বাড়িগুলোর চারপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ, চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে বলে রাখা ভালো যে, শীতের সময় অতিরিক্ত বরফের কারণে এই রাস্তার কিছু অংশ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। পথিমধ্যে চা পানের বিরতিতে ঝর্ণার পানিতে নেমে ছবি তুলে আবার রওনা হলাম। পাহাড়ের গায়ে গাছের বিভিন্ন লেয়ার ও তার চূঁড়ায় সুন্দর-শুভ্র বরফ। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর আমরা সোনামার্গে পৌছালাম। সোনামার্গের যেসব টুরিস্ট পয়েন্ট আছে তার একটু আগে আমাদের গাড়ি থামলো। এখন থেকে গামবুট, জ্যাকেট ও অন্য গাড়ি ভাড়া করতে হয়। আমাদের ড্রাইভার আগেই বলেছিলো যে – লোকাল লোকদের সাথে তাদের কথা বলা নিষেধ, অতএব আপনাকেই সব ঠিক করতে হবে। এখানে নামার সাথে সাথে এসব জিনিস ভাড়া দেয়ার লোকজন আমাদের পিছু নিলো। আমরা তাদেরকে এড়িয়ে চলতে লাগলাম। আইজাজ ভাইয়ের নির্দেশনামতো অনেক দামাদামি করে ৮০ রুপিতে গামবুট নিলাম। আমরা যেহেতু জ্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম তাই জ্যাকেট বাদ দিলাম। এখানে ১৪০০/১৫০০ রুপিতে তিন চারটি স্পট ঘুরার জন্য গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। প্রথমে এরা ৪৫০০ রুপি থেকে শুরু করলো, আমরা সামনে হাঁটা শুরু করলে গাড়ি আমাদের পিছু নিয়ে ভাড়া বাড়াতে অনুরোধ করলো। শেষ পর্যন্ত ১৮০০ রুপিতে গাড়ি ঠিক করলাম যদিও ভাড়াটা একটু বেশি তবুও মেনে নিলাম। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ছেলেদের সাথে কথা বললে ভালো, তারা বেশি ঝামেলা করেনা। এখানে আপনি ৩-৪ ঘন্টা সময় নিয়ে ৩/৪ টি স্পট ভিজিট করবেন। পয়েন্টগুলোর মধ্যে জিরো পয়েন্টে বরফ বেশি – এখানে আপনি স্ল্যাজ ভাড়া নিতে পারেন, প্রতিটি গাড়ি সর্বোচ্চ ২০০ রুপি নিবে। ফেরার পথে ফিশিং পয়েন্টে ঘুরে ড্রপ পয়েন্টের একটু আগে দুপুরের খাবার খেয়ে শ্রীনগরের পথে রওনা হই। শহরে ঢুকার একটু আগেই হজরতবাল মসজিদ, এখানে মহানবী সা: এর দাঁড়ি মোবারাক সংরক্ষিত আছে। মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দাঁড়ি মোবারাক সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। হজরতবাল মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করে শহরে ঢুকলাম। হাতে একটু সময় থাকায় ড্রাইভারকে বললাম কাশ্মীরি শাল ও কাপড়ের দোকানে নিয়ে যেতে। আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, হাতে সময় থাকলে শ্রীনগরে শপিং না করা ভালো। পেহেলগামে দাম তুলনামূলক অনেক কম।
তৃতীয় দিন (১ এপ্রিল) – পাহেলগাম – শ্রীনগর থেকে পাহেলগামের দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। সকালে নাস্তা করে গাড়িতে উঠলাম পাহেলগামের উদ্দেশ্যে। সাথে আমাদের লাগেজ নিয়ে নিলাম – আজ রাত পাহেলগামে থাকবো। রাস্তায় ড্রাইফুড শপে নেমে বাদাম, মরিচ ও মসলা কিনে কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ কাহবা চা খেয়ে আবার রওনা হলাম। ঘন্টাখানেক পর আপেল বাগানে পৌঁছলাম। রাস্তার দুইপাশে বিস্তীর্ণ আপেল বাগানে মাত্র ফুল ফুটেছে। একটি ট্যুরিস্ট পয়েন্টে থেমে আপেলের টাটকা জুস ও চা খেলাম। আবার রওনা হতেই দেখলাম রাস্তায় পাহেলগাম যাওয়ার সবগুলো গাড়ি থেমে আছে। আমাদের ড্রাইভার জানালো ছাত্ররা পাহেলগাম যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, সেনাবাহিনীর ক্রস ফায়ারে বেশকিছু লোক মারা গিয়েছে। আমাদের ড্রাইভার একটু পরে গাড়ি গ্রামের ভিতর ঢুকিয়ে দিলো, ফোনে অনবরত কথা বলতে বলতে গ্রামের পথে চলতে থাকলো। কোথায় যাচ্ছে জানিনা, আবার কাশ্মীরি ভাষাটাও বুঝিনা। সবাই ভীষণ উৎকণ্ঠায়, আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম। একটু পর সে আমাদেরকে জানালো যে – অনেক ঘুরে ঝামেলার জায়গাটা সে এড়িয়ে পাহেলগামের দিকেই যাবে। ঘন্টা দুয়েক এভাবে চলে আবার প্রধান সড়কে উঠলাম। অবশেষে পাহাড় ও পাথরের শহর পাহেলগামে পৌঁছলাম। বিশাল উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে বহমান ঝর্ণার পানির প্রান্তে সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট। শীতের পর বরফ গলে পানির স্রোত বাড়লে এখানে রিভার রাফটিং করা হয়। হোটেলে লাগেজ রেখে লাঞ্চ করে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ে উঠার স্থানটিতে চলে আসলাম। পরামর্শমতো, ঘোড়া ঠিক করার আগে যে ছয়টি পয়েন্টে যাবো তার ছবি তুলে নিলাম। এখান অনেক দামাদামির পর আটজনের জন্য পাঁচটি ঘোড়া ঠিক করলাম। প্রতি ঘোড়া ৯৫০ রুপি করে। পাঁচ বছরের দুই বাচ্চা আমাদের দুইজনের সাথে নিলাম। বড় দুই বাচ্চাকে একটি ঘোড়ায় নিলাম। ঘোড়া ঘুরে ঘুরে একবারে পাহাড়ের চূঁড়ায়য উঠে এবং নামে। ঘোড়ায় চড়ার পূর্বে আপনার পকেটের মোবাইল, মানিব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস ব্যাগে নিয়ে নিবেন, নাহলে পড়ে যেতে পারে। যেসব স্থানে থামবে – বাইসারাণ, পেহেলগাম ভ্যালি, কাশ্মীর ভ্যালি, ওয়াটারফল ও দাবিয়ান। পেহেলগাম ভ্যালিতে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেলো। সামনে বিশাল পাহাড় আর তার গায়ে পুরো শহর। রেশ কাটতে না কাটতেই পৌছলাম উপরের কাষ্মীর ভ্যালিতে। কাশ্মীর ভ্যালি এমন এক জায়গা যেখানে না খেয়েও সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যায়০। নামতে ইচ্ছে করছিলো না। বিকেলে ও সন্ধ্যায় পাহেলগামের ঝর্ণার এপার-ওপার ঘুরলেও ভালো লাগবে।
চতুর্থ দিন (২ এপ্রিল) – আরু ভ্যালি, চন্দনওয়ারী ও বেতাব ভ্যালি – সকাল সকাল উঠে হোটেলে চেক-আউট করার প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম। নাস্তা সেরে লোকাল গাড়ির স্ট্যান্ডে গেলাম। আমাদের ড্রাইভার চার ঘন্টার জন্য গাড়ি ঠিক করে দিলো। গাড়ির ভাড়া প্যাকেজের মধ্যে যুক্ত ছিল তাই আমাদের ড্রাইভার ভাড়াটা অগ্রিম পরিশোধ করে দিলো। গাড়ি আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথ বেঁয়ে প্রথমে আরু ভ্যালি পৌঁছালো। এখানে আপনি ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের উপর যেতে পারেন, পাহাড়ের উপরটা কাশ্মীর ভ্যালির মতো। দরদাম করলে প্রতি ঘোড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা নিবে। আমরা আর ঘোড়া নিলাম না, হেঁটে কিছুদূর ঘুরে আসলাম। আরু ভ্যালি থেকে ফেরার পথে ভ্যালিতে ঢোকার গেট পার হয়ে খুবই সুন্দর একটি জায়গা। দুইদিকে বিশাল পাথরের পাহাড়ের মধ্যে গিরিখাতের মতো নদীতে প্রচণ্ড স্রোত। এখানে থামার জন্য আপনার ড্রাইভারকে আগেই বলে রাখতে হবে।
আরু ভ্যালি থেকে ফিরে রওনা হলাম চন্দনওয়ারীর দিকে। একটু যেতেই ববি সিনেমার (১৯৭৩) বিখ্যাত গান – ‘হাম তুম এক কামড়ে মে বান্দ হো’ গানের শ্যুটিং স্পট দেখা যাবে। পথিমধ্যে পাহাড়ের নিচে বেতাব ভ্যালি চোখে পড়বে। আরু ভ্যালিতে সোনামার্গের মত বরফ পাবেন। এখানে চাইলে গামবুট ভাড়া নিতে পারেন। আমরা নেইনি কারণ, আমরা সবাই পাহাড়ের/বরফের উপর হাঁটার উপযোগী নিচে অমসৃণ দাঁতযুক্ত কেডস পরে গিয়েছিলাম। ১০০ রুপি দিয়ে ছবি তোলার লোক নিয়েছিলাম – সে আমাদের ক্যামেরা দিয়ে ভালো ছবি তুলে দিয়েছে। সোনামার্গের মত বরফ হলেও ভিন্নতার জন্য এখানেও অনেক ভালো লাগবে। ঘন্টাখানেক এখানে কাটিয়ে ফিরতি পথে বেতাব ভ্যালির দিকে রওনা হলাম।
বেতাব ভ্যালির ব্যবস্থাটা একটু ভিন্ন। চারদিকে পাহাড়ের পাদদেশে ঝর্ণার পানি জমে আছে। সরকারিভাবে ভ্রমণ উপযোগী ব্যবস্থা করেছে। এখানে একটি রিসোর্টও বানিয়েছে। শীত মাত্র শেষ তবুও চারদিকে এত সুন্দর পরিবেশ, ধারণা করা যায় আর কিছুদিন পর সব সবুজ হলে, স্বর্গ এখানেই হবে। বের হওয়ার সময় বাংলাদেশ থেকে আসা ১০/১২ জন মহিলার একটি দলের সাথে দেখা হলো, উনারা সব বান্ধবী মিলে কাশ্মীর ঘুরতে এসেছেন। আন্টিদেরকে আমি বলেই ফেললাম – ‘আমি আপনাদেরকে দেখে জেলাস’।
বেতাব ভ্যালি থেকে হোটেলে ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে শ্রীনগরের দিকে রওনা হলাম। গতকালের ঘটনায় সারা কাশ্মীরে ধর্মঘট, সব বন্ধ, রাস্তায় গাড়িও অনেক কম। এমন থমথমে পরিবেশ আগে কখনও দেখিনি। পুলিশ এবং টহলরত সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধ-যুদ্ধ ঘটনা দেখেছি। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম, আমাদের ড্রাইভার মোজাফফরের বিচক্ষণতায় ভালোভাবে শ্রীনগর পৌছালাম। পথিমধ্যে অবশ্য নেমেছি, জাফরান চাষ করা হয় এমন বিস্তীর্ণ মাঠে কোটি কোটি সুন্দর বন্য ফুলের সাথে ছবি তুলেছি।
পঞ্চম দিন (৩ এপ্রিল) – গুলমার্গ – শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ এর দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। যদিও ২ ঘন্টার রাস্তা, ধর্মঘটের কারণে সকালের নাস্তা সাথে নিয়ে ৬:৩০ এ রওনা হয়ে গুলমার্গ পৌঁছে প্রথমে নাস্তা করে নিলাম। এখানে তখন মেঘের অন্ধকার ও সাথে হালকা বৃষ্টি। বৃষ্টি, কাঁদা ও বরফে কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে তাই ১০০ রুপি করে গামবুট ভাড়া নিলাম। ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে ক্যাবল কারের স্টেশন পর্যন্ত ঘোড়া পাওয়া যায়। পরামর্শ অনুযায়ী ঘোড়া না নিয়ে ম্যাপ ধরে হেটে ক্যাবল কার স্টেশনে পৌঁছলাম। এখানে তখন প্রচন্ড ভীড়, টিকেটের বিশাল লাইন। লাইন আসলে দুটি। একটি গাইডদের জন্য, অন্যটি সাধারণ ট্যুরিস্টদের। গাইডের লাইনটি ছোট ছিল, দামাদামি করে ৩০০ টাকায় গাইড নিয়ে তাকে টিকিট কাটার টাকা দিয়ে দাঁড়ালাম। এখানে ক্যাবল কারের দুটি ধাপ, প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টিতে বরফ বেশি থাকে। পরামর্শমত আমরা দ্বিতীয়টিতে যাবো না। শেষ পর্যন্ত টিকিট নিয়ে প্রথম ধাপে পৌঁছলাম। এখানে বলে রাখা দরকার – সোনামার্গ ও চন্দনওয়ারী থেকে বরফ বেশি। কিন্তু বরফ পর্যন্ত পৌঁছুতে রাস্তাটি খুব পিচ্ছিল। সাবধানতা অবলম্বন না করলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক লোকজনকে আছাড় খেতে দেখে উপলব্ধি হলো – ভাড়া করা গামবুটগুলো বহুল ব্যবহারের ফলে নিচে কিছুই নেই, ক্ষয়ে সব সমান হয়ে গেছে। আবহাওয়া খারাপ হয়ে পুরু এলাকা মেঘে ঢেকে গেছে। তাড়াতাড়ি ক্যাবল কার স্টেশনে ফিরে আসলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ষষ্ঠ দিন (৪ এপ্রিল) – পরী মহল, চাচমেশাহী, বোটানিক্যাল গার্ডেন, শালিমার বাগ ও টিউলিপ গার্ডেন – এইদিনে আমাদের পরিকল্পনা ছিলো শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে দুধপাত্রী যাবো। ধর্মঘটের কারণে রাস্তা খারাপ থাকায় শ্রীনগরের বাকিসব স্থানগুলো ঘুরার পরিকল্পনা করলাম। পুরোনো শহরটি ঘুরে দেখা যেত, কিন্তু আমরা প্রকৃতির কাছে যাওয়া বেছে নিলাম।
প্রথমে গেলাম পরী মহল। মুঘল গার্ডেন নামে যে কয়টি স্থান আছে, তার মধ্যে এটিও একটি। ডাল লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে পাহাড়ের উপর সাতটি ধাপে ১৬৫০ সালে এটি তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে ডাল লেক ও শ্রীনগর শহর দেখা যায়। খুবই সুন্দর করে বানানো হয়েছে এই মহলটি। ভিন্ন ভিন্ন ধাপে রয়েছে প্রচুর ফুল ও ফলের গাছ।
পরিমহলের পরে গেলাম চাশমেশাহী। এটি আরেকটি মুঘল গার্ডেন যেটি ১৬৩০ সালে একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণাকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছিলো। এই ঝর্ণার পানি উপাদেয় ও উপকারি ছিলো। কথায় আছে, খাবার খাওয়ার পর এ পানি খেলে খুব সহজেই খাবার হজম হয়ে যায়। এখন অবশ্য এটি খাওয়ার উপযোগী মনে হয়নি।
এবার বোটানিক্যাল গার্ডেনের পালা। বিস্তীর্ণ এই বাগানের একপাশে চশমেশাহী ও অন্যদিকে টিউলিপ গার্ডেন। বাগানের মধ্যে বিশাল এলাকাজুড়ে লেক রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার ফুল ও ফল গাছ দিয়ে এমনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে যে সারাদিন এই বাগানে কাটিয়ে দেয়া যাবে।
টিউলিপ গার্ডেন ও নিশাত গার্ডেন পার হয়ে এবার গেলাম শালিমার বাগে। এটিও আরেকটি মুঘল গার্ডেন যা সম্রাট জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী নূরজাহানের জন্য ১৬১৯ সালে তৈরি করেছিলেন। ডাল লেকের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত এই বাগানটি পাহাড়ের উপর থেকে নিচে বয়ে যাওয়া একটি লেককে ঘিরে চারটি স্তরে তৈরি করা হয়েছে। লেকের মাঝে ফোয়ারা দিয়ে সাজানো হয়েছে যেখানে অনবরত পানি পড়ছে।
সবশেষে গেলাম টিউলিপ গার্ডেনে। প্রথমদিনও গিয়েছিলাম – মন ভরেনি। এবার হাতে অনেক সময় নিয়ে গেলাম। এখন বাগান আরও অনেক রকম ফুল দিয়ে পরিপূর্ণ এবং অধিকাংশ টিউলিপ ফুটেছে। এবার বাগানে অনেক ভীড়। বিদেশী পর্যটকদের সাথে স্থানীয় লোকজনও প্রচুর। আসলেই, কাশ্মীর আসলেন আর টিউলিপ গার্ডেন দেখলেন না – আপনার ভ্রমণ অপূর্ণই রয়ে গেলো।
সপ্তম দিন (৫ মে) – শিকারা বোট রাইড – আজ আমাদের ফিরতি ফ্লাইট। সকালে নাস্তা খেয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিকারা বোট রাইডের জন্য রওনা হলাম। সাথে লাগেজ নিয়ে নিলাম যাতে আর হোটেলে ফিরতে না হয়। কাশ্মীর ভ্রমণে অবশ্য করণীয় হলো ডাল লেকের শান্ত পানিতে শিকারা বোটে করে ২/৪ ঘন্টা ঘুরে বেড়ানো। ডাল লেকের এক প্রান্তে অসংখ্য হাউসবোট রয়েছে। এইসব হাউসবোটে রাত্রিযাপন খুবই মজার। এছাড়াও ভাসমান নৌকায় বাড়ি ও দোকান রয়েছে। লেকের পানিতে মাছ ও হাঁস দেখা যায়। সারা বছরই লেকে ভাসমান নৌকায় বিভিন্ন প্রকার জিনিস ফেরি করে বেড়ায়। জুন-জুলাই এখানে ভাসমান নৌকায় ফুল ও ফলের দোকান খুবই বিখ্যাত। ডাল লেকে ভ্রমণ শেষে আমরা শ্রীনগর এয়ারপোর্টে পৌঁছে সাতদিনের সঙ্গী আমাদের ড্রাইভার মোজাফফর ভাইকে বিদায় দিয়ে ছল-ছল চোখে চেক-ইন কাউন্টারের দিকে অগ্রসর হলাম। এখন নীড়ে ফিরে যাওয়ার সময়।
বোর্ডিং এর পর বসে বসে ভাবছি কি নিখাত ভালোবাসা দিয়েছে কাশ্মীরের লোকজন। পাহেলগামে বশির ভাই, শ্রীনগরে কাইয়ুম ভাই, শাফি ভাই, মোজাফফর ও সর্বোপরি আইজাজ ভাই। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
আসুন সুন্দর এই পৃথিবীকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রেখে যাই এবং পরিবেশ দূষণ হয় এমন সকল প্রকার কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকি।
লেখক : এম রাশিদুল হাসান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সিসটেক ডিজিটাল লিমিটেড