বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নায়াগ্রা জলপ্রপাত প্রকৃতির এক মহাবিস্ময়। এই জলপ্রপাতের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুজে পাওয়া মুশকিল। ভ্রমন পিপাসু সকল প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের কাছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি একটি রোমাঞ্চকর স্থান। এখানে গেলে যে কারো মনে হতে পারে এই বুঝি আকাশ ভেঙ্গে জগতের সব বৃষ্টি দানব আকার ধারন করে সিড়ি বেয়ে বেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ছে।
আমেরিকা ও কানাডার সীমান্তবর্তী নায়াগ্রা নদীর উপর অবস্থিত নায়াগ্রা জলপ্রপাতটি মূলত তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টি। সবচেয়ে বড় জলপ্রপাতটির নাম হলো হর্সশু ফলস বা কানাডা ফলস। এটি প্রায় ১৬৭ ফুট উঁচু থেকে ২৬০০ ফুট চওড়া পানির স্রোত নিয়ে নিচে আছড়ে পড়ে। বলা হয় নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রায় ৯০ ভাগ পানি এই ফলস দিয়েই পতিত হয়। এর পরের ফলসটির নাম আমেরিকান ফলস। এটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এবং ১৬০০ ফুট চওড়া। অন্যটির নাম ব্রাইডল ভেইল ফলস।
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উৎপত্তির ইতিহাসটা বেশ মজার। নায়াগ্রা নদীটি প্রায় ১২০০ বছরের পুরনো।এরও আগে ১৮০০ বছর পূর্বে ওন্টারিওর দক্ষিণে প্রায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটার বরফে ঢাকা ছিল। সময়ের সাথে সাথে আর নিয়মিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় পরিবর্তনের ফলে গলতে শুরু করে বরফ আর গ্রেট লেকস বেসিনে প্রচুর পানি জমতে থাকে এবং লেক ঈরি , নায়াগ্রা নদী আর লেক ওন্টারিও থেকে আসা পানি মিলে এই বিশাল জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
“Onguiaahra” শব্দ থেকে নায়াগ্রা শব্দের উৎপত্তি, যার মানে হলো জলরাশির বজ্রধ্বনি। সত্যিই তাই। প্রায় বিশ কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায় এই পানি পতনের গর্জন। আর গর্জনের এতই শব্দ যে, স্রোতের শব্দে আর অন্য কোন শব্দ কানে আসেনা। এখন এই জলপ্রপাত দিয়ে প্রতি মিনিটে প্রায় ৬০ লক্ষ ঘনফুটেরও বেশি পানি প্রবাহিত হয়। রাতের নায়াগ্রা যেন এক স্বপ্নপুরী। আলোকরশ্মীর আলোয় পরিবর্তিত হতে থাকা পানির ধারাকে মনে হয় এক অপার্থিব সৌন্দর্যের খনি।
শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, পানির এই স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। আর এই বিদ্যুতে চলে আশেপাশের কারখানা সহ জাতীয় বিদ্যুৎ বোর্ড। এটি পুরো নিউইয়র্ক ও ওন্টারিওর জলবিদ্যুৎ শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস। একবার ১৯৪৮ সালের দিকে বরফ জমে প্রায় ৪০ ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায় পানির স্রোত আর বিপাকে পড়ে কারখানাগুলো সহ দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। ১৯৫০ সালে নায়াগ্রা চুক্তির মাধ্যমে জলপ্রপাতের পানির নিয়ন্ত্রন করা শুরু হয়। বর্তমানে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প কারখানায় অবদান রাখার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে দেশের রাজস্ব সংগ্রহে বিশাল ভুমিকা রাখছে।
ভ্রমন পিপাসুরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পাড়ি জমাতে পারেন নায়াগ্রা জলপ্রপাতে। এর জন্য গ্রীষ্মকাল আর বসন্তই সবচেয়ে আদর্শ সময়। প্রকৃতির অ্যাডভেঞ্চার নিতে অভিযাত্রীদের জন্য আছে “মেইড অফ দ্যা মিস্ট” নামের জাহাজ। এর মাধ্যমে জলপ্রপাতের খুব কাছে গিয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। জাহাজটি আপনাকে নিয়ে যাবে স্রোতের গভীর নিচে আর পিছনে। আর রাতের নায়াগ্রা জলপ্রপাততো এক রুপকথার রাজ্য। বর্ণীল ঘোরময় পরিবেশ। জলপ্রপাতের পাশাপাশি পর্যটকেরা ঘুরে আসতে পারবে প্রজাপতি ভান্ডারে, যেখানে আছে দুই হাজারেরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি। পর্যটকেরা আরো যেতে পারেন নায়াগ্রার আ্যকোয়ারিয়াম, নায়াগ্রা সায়েন্স মিউজিয়াম, ওয়ার্লপুল স্টেট পার্ক, ডেভিল’স হোল স্টেট পার্ক, রিসার্ভার স্টেট পার্ক, নায়াগ্রা আ্যডভেঞ্চার থিয়েটার এবং হাইড্ পার্ক। নায়াগ্রা জলপ্রপাত এক প্রকৃতির অপার সৃষ্টি। সময় সুযোগ হলে কেউ ঘুরে আসতে ভুলবেন না।