২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। বাংলা ৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯। বৃহস্পতিবার। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ কর্তৃক প্রস্তাবিত হরতাল প্রত্যাহার করায় ঢাকায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটি শুরু হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই।
এর আগের দিন বুধবার সন্ধ্যায় (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ঘোষণা আসে পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এ খবর শুনে ছাত্র নেতারা হতাশ হয়ে পড়েন এবং হরতাল বাতিল ও ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। রাত ১০টার দিকে এ সিদ্ধান্তের সংবাদ মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়।
তবে একই সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ‘কর্মপরিষদের’ সদস্য নন এমন কয়েকজন নেতাকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, রাতেই তৎকালীন ঢাকা হলের পুকুরের পূর্বপাড়ের সিঁড়িতে জরুরি গোপন বৈঠক হবে।
রাত ১২টায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন: গাজীউল হক (আইনজীবী), হাবীবুর রহমান (বিচারপতি), মোহাম্মদ সুলতানা, এম আর আখতার মুকুল, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এস এ বারী এটি, সৈয়দ কামরুদ্দীন হোসেইন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, মঞ্জুর হোসেন ও আনোয়ার হোসেন।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পরের দিন আমতলায় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক। যদি তিনি গ্রেপ্তার হন তবে সভাপতি হবেন এম আর আখতার মুকুল এবং তাকেও যদি গ্রেপ্তার করা হয় তবে সভাপতিত্ব করবেন কামরুদ্দীন শহুদ।
একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সময়মতোই যানবাহন চালু হওয়া ছাড়াও দোকানপাট আর অফিস-আদালতগুলো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠল। শুধু টাউন-টু-এ সার্ভিসের বাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ভবনের সম্মুখ দিয়ে চলাচল বন্ধ করে একটা বিকল্প রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছিলো।
আর এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম সেই মাঠটিতে সকাল থেকে কয়েক সহস্র পুলিশ আস্তানা গাড়ল। সঙ্গে পুলিশের 'স্পেশাল টিয়ার গ্যাস স্কোয়ার্ড।
বেলা সাড়ে ৮টা নাগাদ ঢাকার শহরতলি থেকে স্কুলের ছাত্রদের ছোট ছোট মিছিল এসে জমায়েত হতে শুরু করল বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে চত্বরে। সকাল ৯টা নাগাদ এলো বিভিন্ন কলেজের ছাত্র শোভাযাত্রা।
বেলা সাড়ে ৯টা নাগাদ বিভিন্ন পথ ধরে মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের হাজার হাজার ছাত্র বন্যার পানির মতো হাজির হলো সভাস্থলে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১০ হাজারের মতো। চারদিকে মুহুর্মুহু শুধু 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লােগানে মুখরিত। এদিকে কলাভবনের সামনে রাস্তায় দলে দলে সশস্ত্র পুলিশ টহল দিতে শুরু করেছে। আর টিয়ার গ্যাস স্কোয়াডগুলো 'পজিশন' নিয়ে হুমুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
এমনি এক উত্তেজনাকর পরিবেশের পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক এমআর আখতার মুকুলের প্রস্তাব ক্রমে এবং সৈয়দ কমরুদ্দিন শহুদের সমর্থনে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গাজিউল হক সভাপতি হিসেবে আগের মতোই এই ঐতিহাসিক ছাত্রসভার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথমে সর্বদলীয় কর্মপরিষদের পক্ষে ১৪৪ ধারা না ভাঙার আহক্ষান জানিয়ে বক্তৃতা করলেন শামসুল হক সাহেব।
অবশ্য সভাস্থল ত্যাগ করার সময় তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানালেন আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা। এ সময় প্রথম সংবাদ এসে পৌঁছল যে, লালবাগ এলাকায় পুলিশ একটা স্কুলের ছাত্র মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ করা ছাড়াও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। ফলে উত্তেজনা তখন তুঙ্গে।
এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহক্ষায়ক আবদুল মতিন (পরবর্তীতে উগ্র বামপন্থী নেতা) এবং সভাপতি গাজিউল হক উভয়েই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তৃতা করলেন। এদের বক্তব্যই প্রস্তাবাকারে পাস হয়ে যায়।
চতুর্দিকে গগণবিদারী সস্নোগান উচ্চারিত হলো, '১৪৪ ধারা মানি না, মানি না।' তখন সাধারণ ছাত্রদের মনমানসিকতার নেতারা হতভম্ব। এতসব হৈচৈয়ের মাঝেও সিলেটের আবদুস সামাজ আজাদ (বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা) কীভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে তার প্রোগ্রাম বর্ণনা করলেন।
তিনি বললেন, একইসঙ্গে এই হাজার হাজার ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরোলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। এরচেয়ে প্রতি দফায় রাস্তায় ১০ জন করে ছাত্রের মিছিল বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন 'প্রোক্টর' মুজাফ্ফর আহম্মদ চৌধুরী (বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভিসি) এ ব্যাপারে সমর্থন প্রদান করে কলা ভবনে লোহার গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
শুরু হলো ছাত্রদের 'দশজনী মিছিল।' প্রথম দলের নেতৃত্ব দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী (পরবর্তীকালে বিচারপতি), দ্বিতীয় দলে আবদুস সামাদ আজাদ ও মরহুম ইব্রাহীম তাহা এবং তৃতীয় দলে আনোয়ারুল হক খান (পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারের তথ্য সচিব) এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান (স্বাধীন বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত)।
এই 'দশজনী মিছিলে' যোগদান করে যারা গ্রেফতার হচ্ছিলেন, তাদের তালিকা প্রণয়ন করার দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান (পরবর্তীতে বামপন্থী নেতা) এবং কাজী আজহার (সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব)। এমন সময় আকস্মিকভাবে পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ ও অবিরাম কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কাঁদুনে গ্যসের ধোয়ায় ছেয়ে যায় চারিদিক।
ছাত্ররা দৌঁড়ে কলাভবনের পুকুরে এসে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আবার মিছিলে যোগ দেন। এমনি সময়ে একটি টিয়ারশেল সরাসরি গাজীউল হকের বুকে এসে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সে সময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলায় মেয়েদের কমন রুমে রেখে আসা হয়। বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত কলা ভবন এলাকায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলতে থাকে।
তখন পর্যন্ত ঢাকার অন্যান্য স্থানে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একদিকে চলতে থাকে পুলিশের লাঠিচার্জ আর অন্যদিকে ছাত্রদের ইট-পাটকেল নিপে। এ পরিস্থিতিতে ছাত্ররা যাতায়াতের সুবিধার জন্য কলা ভবন ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যবর্তী দেয়াল ভেঙে দেয়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের দিক পরিবর্তিত হয়। ছড়িয়ে পরে সংঘর্ষ চারিদিকে। এ সময় পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে আহত হন বহু ছাত্র।
এমনই অবস্থায় কোনো রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই একদল সশস্ত্র পুলিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশির নির্দেশে দৌঁড়ে এসে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে ‘ওয়ালী ফায়ার’ করে। চারিদিকে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ার ভেতর কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিছু তাজাপ্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, অনেকে আহত হয়, বাকিরা বিপ্তি হয়ে পড়ে। তখন সময় বিকেল ৩টা ১০ মিনিট। আর দিনটি ২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার।
একটি লাশের মাথার অর্ধেকটাই গুলিতে উড়ে যায়। পরে জানা যায়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকত। সে সময় পর্যন্ত ঘটনাস্থলে নিহতের সংখ্যা ছিল ২ এবং আহত ৯৬। সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে মারা যান আরও দুজন। এরা হলেন শহীদ জব্বার ও রফিক উদ্দিন।
২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে শহীদ হওয়া ৪ জনের মধ্যে তিনজন ছাত্র। এরা হলেন আবুল বরকত, জব্বার ও রফিক উদ্দিন। অপরজন শহীদ সালাম যিনি বাদামতলীর একটি প্রেসের কর্মচারী ছিলেন। ওই দিন এছাড়া রাস্তায় পড়ে থাকা আরও কিছু লাশ পুলিশ দ্রুত ট্রাকে করে নিয়ে যায়। যাদের পরিচয় আর জানা যায়নি। সেই থেকে বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ২১ শে ফেব্রুয়ারি।
তথ্যসূত্র : এমআর আখতার মুকুল রচিত ‘একুশের দলিল’