ঝালমুড়ি বা চানাচুর কেনার সময় বেশী ঝাল নিয়ে কান গরম করেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। অন্যান্য সব দেশের মানুষের চেয়ে বাঙ্গালীরা ঝাল খেতে পছন্দ করে বেশী। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাসিন্দারাও বেশ ঝাল খেয়ে থাকেন। আমাদের দেশী সবুজ মরিচগুলো ভালো ঝাল হয়ে থাকে। একটি মরিচ নিয়ে চিবিয়ে খেলে কিছুক্ষণ ঝালের চোটে হা করে থাকতে হবে। গ্লাসের গ্লাসের পর পানি পান করেও ঝাল কমানো সম্ভব হবে না।
বোম্বাই মরিচ বা নাগা মরিচের কথা আমরা সবাই জানি। এক কামড় খেয়ে ফেললেই শেষ! ক্যাপসিকামও কিন্তু এক ধরণের মরিচ, অথচ আস্ত একটা ক্যাপসিকাম চিবিয়ে খেয়ে ফেললেও তেমন ঝাল লাগবেনা। তাহলে সবগুলোই মরিচ হওয়া সত্ত্বেও কোনটার ঝাল বেশী, আবার কোনটার ঝাল কম হবার কারণ কি? আবার কোন মরিচ কতটুকু ঝাল তা আবার মাপা সম্ভব নাকি?
প্রথমে আসি মরিচ ঝাল কেন হয় তা নিয়ে। মরিচে ক্যাপসাইসিন (Capsaicin) নামক এক ধরণের পদার্থ থাকে যার কারণে মরিচ খেলে ঝাল লাগে। ক্যাপসাইসিন মূলত তৈরি হয় কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের মিশ্রণে। কিন্তু কার্বন ও হাইড্রোজেনের পরিমাণ নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের চেয়ে বেশী। খেয়াল করলে দেখা যাবে মরিচ খেয়ে ঝাল লাগলে পানি পান করে খুব একটা লাভ হয় না। এর কারণ হল, ক্যাপসাইসিনে নাইট্রোজেন, অক্সিজেনের মত ইলেক্ট্রোনেগেটিভ পরমাণুর অনুপাত কার্বন আর হাইড্রোজেনের থেকে অনেকটাই কম হওয়ায় পানি পান করে ঝাল কমানো সম্ভব হয় না। বাড়িতে যে তেল দিয়ে রান্না করা হয়, সেটি মূলত শুধু কার্বন আর হাইড্রোজেন দিয়েই তৈরি। তাই খাবারে ব্যবহৃত তেল ক্যাপসাইসিনকে সহজেই প্রশমিত করতে পারে।
আমরা জানলাম যে, মরিচে ক্যাপসাইসিন থাকার ফলেই মরিচ খেলে ঝাল লাগে। অতএব, এই ক্যাপসাইসিনের পরিমাণ মাপতে পারলেই কোন মরিচ কতটুকু ঝাল তা মাপা যাবে। ১৯১২ সালে এক মার্কিন বিজ্ঞানী উইলবার স্কভিল একটি স্কেল আবিষ্কার করেন যা দিয়ে মরিচে অবস্থিত ক্যাপসাইসিনের পরিমাণ মাপা যাবে। তাঁর নামানুসারে এই স্কেলের নামকরণ করা হয় স্কভিল স্কেল।
স্কভিল স্কেলে ঝাল মাপার জন্য যেকোনো মরিচের কিছুটা শুকনো অংশ নিয়ে তা অ্যালকোহলে মেশানো হয়। অ্যালকোহলে মেশানোর ফলে মরিচে অবস্থিত ক্যাপসিনয়েড অংশটুকু আলাদা হয়ে যায়। তারপর একে কিছুটা চিনি মিশ্রিত পানির সাথে মেশানো হয়। তার ফলে মিশ্রণটির ঘনত্ব বাড়ে এবং এর পরে মিশ্রণটি স্কভিল স্কেল দিয় মাপা হয়। স্কভিল স্কেলে ঝাল মাপার জন্য রেটিং দেয়া হয়। যে মরিচের রেটিং যত বেশী, তার ঝাল তত বেশী। মরিচে অবস্থিত ক্যাপসাইসিনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে রেটিং করা হয়।
আমাদের আশেপাশে মরিচগুলোর মধ্যে নাগা মরিচই সবচেয়ে ঝাল। কিন্তু এর চেয়ে বহুগুণ বেশী ঝাল মরিচও রয়েছে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের “ ভূত জোলোকিয়া ” ছিল সবচেয়ে ঝাল মরিচ। স্কভিল স্কেলে এর রেটিং ছিল ১,০৪১,৪২৭। এরপর, ২০১০ সালের দিকে ব্রিটেনের এক কৃষক বেশ কয়েক ধরণের ঝাল মরিচের শংকর করে উৎপন্ন করেন ভয়ংকর ঝাল এক মরিচ, যার নাম “ নাগা ভাইপার ”। স্কভিল স্কেলে এর রেটিং ১,৩৮২,১১৮। আবার, ২০১৪ সালের দিকে উৎপন্ন হয় “ ক্যারোলিনা রিপার ”, যেটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ঝাল মরিচ। স্কভিল স্কেলে এর রেটিং দেখলে মাথা ঘুরে যাবার মত অবস্থা হবে। এর রেটিং হল ১,১৫০,০০০ থেকে ২,২০০,০০০ এর মধ্যে। এইসব মরিচগুলো এতটাই ঝাল যে একবার এগুলো খেয়ে ফেললে পানি, দুধ, চিনি কোনকিছু খেয়েই লাভ হবে না। অন্তত কয়েক ঘন্টার জন্য ঝালের চোটে পাগল হয়ে থাকতে হবে। এইসব মরিচের ঝাল যে শুধু মুখে লেগে থাকে, তা না। একবার এই মরিচগুলো খেলে মুখ থেকে পেট পর্যন্ত জ্বলতে থাকবে। মনে হবে শরীরের ভেতরে আগুন ধরে গেছে। এমনকি এই মরিচগুলো খাওয়ার সাথে সাথে ঝাল সহ্য করতে না পেরে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
নিচের ছকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল কিছু মরিচের নাম ও রেটিং দেয়া হল।
চিত্র |
নাম |
স্কভিল স্কেলে রেটিং |
|
বেল পেপার (Bell Pepper) |
০ |
|
ব্যানানা পেপার (Banana Pepper), প্যাপ্রিকা (Paprika) |
১০০-৯০০ |
|
জ্যালাপিনো (Jalapeno), প্যাসিলা (Pasilla) |
১০০০-৪০০০ |
|
গুয়াজিলো (Guajillo), ফ্রেসনো (Fresno) |
৩৫০০-৬০০০ |
|
সেরানো (Serrano), অ্যালেপ্পো (Aleppo) |
১০০০০-২৩০০০ |
|
গুন্টুর (Guntur), টাবাস্কো (Tabasco) |
৩০০০০-৫০০০০ |
|
বার্ড’স আই (Bird’s Eye) |
১০০০০০-২২৫০০০ |
|
রেড স্যাভিনা হাবানেরো (Red Savina Habanero) |
৩৫০০০০-৫৮০০০০ |
|
নাগা ভাইপার (Naga Viper), ভূত জোলোকিয়া (Bhut Jolokia), কমোডো ড্রাগন (Komodo Dragon) |
৮৫৫৩০০-২১৯৯৯৯৯ |
|
ক্যারোলিনা রিপার (Carolina Reaper) |
১৫০০০০০-২২০০০০০ |