প্রতিদিনের মতোই একসঙ্গে খেলছিলো অভি আর রাতুল। আলাদা স্কুলে পড়লেও ওরা পাশাপাশি পাশাপাশি বাসায় থাকে। স্কুল থেকে ফিরেই একজন চলে যায় অন্যজনের বাসায় খেলতে। আজ রাতুল এসেছে অভিদের বাসায়। হঠাৎ করেই রাতুলের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন অভির মা। ঘরে ঢুকেই তার চক্ষু চড়কগাছ।
মেঝেতে পড়ে রয়েছে রাতুল। তার সামনের ঠোঁট কেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। অভির মা দ্রুত রাতুলের ঠোঁটে বরফ ঘষতে ঘষতে চোখ গরম করে অভিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে মারামারি করছিলে তোমরা?
অভি বেশ অবাক হয়ে উত্তর দিলো, 'মারামারি করছিলাম না তো, আমরা রেসলিং-রেসলিং খেলছিলাম। রাতুলকে একটা choke slam দিতেই এই অবস্থা'। ক্লাস থ্রি-পড়ুয়া বাচ্চার মুখে এই কথা শুনে হতবাক হয়ে যান অভির মা।
অভির মা বা আপনি big boot, choke slam, rock bottom, 619, pedigree টাইপ শব্দগুলো শুনে অবাক হলেও WWE-এর বদৌলতে বাচ্চাদের কাছে এগুলো একবোরে পরিচিত শব্দ।
World Wrestling Entertainment বড় থেকে ছোট অনেকেরই খুব পছন্দের টিভি শো। পরিবারের সবাই মিলে এই মারামারির টিভি শো উপভোগ করেন এমন সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যারা দেখেন তাদের অনেকেরই ধারনা পুরো ব্যাপারটাই সত্যি সত্যি ঘটছে এখানে মেকি কিছু নেই।
বিশেষ করে ছোটরাতো মানতেই চায় না যে কেউ এ ধরণের মারামারির অভিনয় করতে পারে এবং নিজে ইচ্ছা করে মার খেতে পারে। নিছক বিনোদনের এই টিভি শোটি মাঝে মাঝে বাচ্চাদের জন্য বিপদজনকও হয়ে ওঠে।
দেখা যায়, দুই ভাই বা দুই বন্ধু মিলে হঠাৎ খেলতে খেলতে রেসলিং শুরু করলো। পছন্দের রেসলার-এর সিগনেচার মুভ অন্যের উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেই কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটে।
যদিও “Please do not try this at home” -ট্যাগ লাইনটি অনুষ্ঠানের প্রতি পর্বের পরেই দেওয়া হয়, কিন্তু বাচ্চারা খেলার ছলে সেগুলো অনুশীলন করে ফেলে। শিশুরা অনুকরন প্রিয়। তারা যা দেখে তাই শিখে। দেখা যায় মারামারির এসব খুঁটিনাটি কলাকৌশল তারা টেলিভিশনে দেখে শিখছে।
স্কুলে বা বন্ধুদের সাথে কখনো ঝগড়া হলে তাদের উপর সেটা প্রয়োগও করছে। যা ধীরে ধীরে তাকে হিংস্র ও অস্থির করে তোলে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহিন ইসলাম চ্যাম্পস টোয়েন্টিওয়ান ডটকমকে জানান, 'বাচ্চারা অনুকরন প্রিয়। তারা যাই দেখে তার একটি ছবি তার মস্তিষ্কে গঠিত হয়।
সে সেখান থেকে অনেক সময় ভালো খারাপ বের করে নিতে পারে না। সে যখন এই ধরনের কোন অনুষ্ঠান দেখে, তখন সে যা দেখছে তার মাথায় সেই ক্যারেক্টারটাই কাজ করে। এর ফলে দেখা যায় অনেক সময় কোন ঝামেলায় পড়লে বন্ধুকেও মারছে।
এমনকি টিচারকেও অসম্মান করছে। এই ব্যাপারটা খেয়াল রাখতে হবে শিশুটির অভিভাবককে। বাচ্চারা যেন অনুষ্ঠান দেখার পরে প্র্যাকটিস না করে। অনুষ্ঠান দেখার সময় বাবা-মা বা বড় ভাই বোন যেই সঙ্গে থাকুক না কেন তাদের বাচ্চাটিকে অনুষ্ঠানের নেতিবাচক দিকগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে।'
অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চাদের মধ্যে প্রতিযোগী মনোভাব থাকে। একজনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এই চেষ্টা করে সে সারাক্ষন। রেসলিঙেও ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। একজনকে পরাজিত করে নিজে জয়ী হওয়া। অধিকাংশক্ষেত্রে বাচ্চারা বা কিশোর-কিশোরীরা এই জয়-পরাজয়ের সঙ্গে বাস্তব জীবনকে গুলিয়ে ফেলে। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মা, শিক্ষক বা বড় ভাইবোনদের কাজ হচ্ছে বাচ্চাটিকে বুঝানো। তাদেরকে ভুল ও সঠিকের মাঝে পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়া।
শুধু রেসলিং নয় বড়দের যে কোন চ্যালেঞ্জিং শো দেখে অনেকে উঁচু থেকে লাফ দেওয়া, চেয়ার শট দেওয়া, টেবিলের মধ্যে মাথা বাড়ি দেওয়া এসব নিজে অনুশীলনের চেষ্টা করে ছোটরা। এসব করতে গিয়ে অনেক ধরণের দুর্ঘটনাই ঘটতে পারে। তাই অভিভাবকদের উচিত এসব অনুষ্ঠান দেখা থেকে শিশুদের বিরত রাখা।
আর যদি দেখেই তাহলে তাকে 'please do not try this at home' -এই ট্যাগ লাইনটির অর্থ বুঝিয়ে দেয়া কর্তব্য। এই ট্যাগ লাইনটি কেন বারবার অনুষ্ঠানে বলা হয় তার মর্ম বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। রেসলিং বা চ্যালেঞ্জিং শোগুলোতে মূলত শিক্ষণীয় কিছু নেই, শুধু মাত্র বিনোদনের মাধ্যম এগুলো। তাই এখান থেকে আপনার সন্তান যেন ধ্বংসাত্মক ব্যাপারগুলো আয়ত্ত না করে সেদিকে আপনাকেই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।