নাম শুনে হয়তোবা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হতে পারে। জঞ্জাল আবার মহাজাগতিক হয় কেমন করে ! আসলে মহাকাশের সব গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি সব বস্তুকেই মহাজাগতিক বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মহাকাশে জঞ্জাল? হ্যাঁ, মহাকাশেও জঞ্জাল আছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই উন্নতির শিখরে এখন মানুষের অসাধ্য প্রায় কিছুই নেই। পৃথিবীটা দখল করে এখন মানুষের নজর আকাশের দিকে। রকেট আবিস্কার করে মানুষ মহাকাশও হাতের মুঠোয় নিয়ে আসছে সহজেই।
চাঁদে মানুষ পা রেখেছে সেই বিংশ শতাব্দীতেই। আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলেও এখন মানুষ যাই যাই করছে। মোটকথা, আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষের হাতের বাইরে কিছুই নেই। কিন্তু জয় করতে করতে মানুষ এখন রক্ষণাবেক্ষণ করা ভুলে গেছে। পুরো পৃথিবীটা ছেয়ে গেছে দূষিত পদার্থ আর বিষাক্ত গ্যাসে। সেই দূষণ এখন পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশেও পৌঁছেছে। না, বাতাসে ভেসে না।
আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে উপকারী আবিস্কারের মধ্যে একটি হল কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট। এর কল্যাণে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন সবচেয়ে সহজ। যেখানে কোন মোবাইল অপারেটর কোম্পানি নেটওয়ার্ক বসাতে পারে না, সেখানেও স্যাটেলাইটের কল্যাণে মানুষ যোগাযোগ করতে পারছে। কিন্তু এই স্যাটেলাইটগুলো অচল হচ্ছে অহরহ। আবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে এদের বিস্ফোরণও ঘটছে। এইসব স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ ভুতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাকাশে। এমন সব অচল ও অকাজের জিনিসগুলোকেই মহাজাগতিক জঞ্জাল ( Space Junk ) বলে। এরা যে শুধু নামে জঞ্জাল তাই না, কাজেও জঞ্জালের মতোই আচরণ করে। এদের কারনে সচল স্যাটেলাইটগুলোর গতিপথে সমস্যা সৃষ্টি হয় ও যোগাযোগ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ে।
সারা পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপিত মোট স্যাটেলাইটের সংখ্যা প্রায় এক হাজারেরও বেশী। এছাড়া মহাকাশে স্থাপিত আন্তর্জাতিক মহাকাশ ষ্টেশন তো আছেই। মহাজাগতিক সব জঞ্জালের খবর রাখার জন্য মহাকাশে স্থাপিত হয়েছে “US Space Surveillance Network”। এই নেটওয়ার্ক আসলে ১০ সেন্টিমিটার ও তার বেশী বস্তুগুলোকেই কেবল চিহ্নিত করতে পারে। এই নেটওয়ার্কের হিসাবে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মহাকাশে জঞ্জাল ছিল ১০ হাজারের মতো। আর ২০১১ সাল পর্যন্ত এর সংখ্যা ১৬ হাজারেরও বেশী। আরও এক হিসাবে দেখা যায় যে মহাকাশে ময়লার টুকরো রয়েছে ২২ হাজারেরও বেশী। এতো দ্রুত জঞ্জাল বৃদ্ধির পেছনে মানুষের ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত অনেক ভুলই দায়ী।
২০০৭ ও ২০০৯ সালে পরপর দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০০৭ সালে চীন তাদের একটি আন্টি-স্যাটেলাইট মিসাইল পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাদের একটি অচল স্যাটেলাইটের ওপর ছুঁড়ে মেরেছিল, যার ফলে স্যাটেলাইটটি প্রায় দেড় লাখ টুকরোতে পরিণত হয়। এই টুকরোগুলো ১০ সেন্টিমিটারও ছোট হওয়াতে US Surveillance Network-এরও চোখে পড়েনি। আবার ২০০৯ সালে একটি সচল স্যাটেলাইটের সাথে সংঘর্ষ ঘটে রাশিয়ার অচল একটি স্যাটেলাইটের। এর ফলেও অসংখ্য আবর্জনার সৃষ্টি হয়।
নাসার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী মহাকাশে এমন ৪০টিরও বেশি জঞ্জাল রয়েছে যেগুলোর ওজন তিন টনের বেশী। এগুলো যেকোনো মহাকাশযান বা স্যাটেলাইটের ওপর পড়লে তার একদম দফারফা ! এছাড়াও ছোট ছোট জঞ্জালের টুকরোগুলো ঘণ্টায় ১৭ হাজার মাইল বেগে পৃথিবীর আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো যেকোনো মহাকাশযানের ওপর পড়লে সেটি সহজেই ফুটো হয়ে যাবে। ২০১২ সালের দিকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ ষ্টেশন এমন একটি সংঘর্ষের মুখে পড়েছিল। তখন সেখানে ছয়জন নভোচারী ছিলেন। অবস্থা বুঝতে পেরে তাঁরা সময়ের আগেই পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
এসব দুর্ঘটনা ঠেকাতে প্রত্যেক দেশের উচিত তাদের দ্বারা নির্মিত জঞ্জালগুলো পরিষ্কার করা। এ ব্যাপারে কোন এক দেশ একা কিছু করতে পারবে না। কারণ মহাকাশ আইন অনুসারে এক দেশের কাজের ফলে তৈরি জঞ্জালে অন্য দেশ হাত দিতে পারে না। তাই এই কাজে সবার নিজ থেকে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।