এত দুঃখ নিয়ে আমি এর আগে কখনও কাগজ কলম নিয়ে বসিনি।
গত বছর যখন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সবাই মিলে চিৎকার চেঁচামেচি করছিলাম, তখন একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলে গেছে আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, কিছু কিছু ‘সাজেশন’ প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ঘটনাক্রমে মিলে গেছে মাত্র।
যারা এটা বলেছেন, তারা নিজেরাও জানেন যে, দেশের মানুষ এত বড় নির্বোধ নয় যে, তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই কথাগুলো বিশ্বাস করবে। আমরা ভেবেছিলাম যথেষ্ট চেঁচামেচি করার কারণে এবারে হয়তো সবাই একটু বাড়তি সতর্ক থাকবে, প্রশ্নপত্র হয়তোা এবারে ফাঁস হবে না।
আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমার কাছে আগের রাতে পাঠানো হয়েছে, পরের দিন পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। কেউ যদি বিশ্বাস না করেন নিজের চোখে দেখতে পারেন (নিচের ছবি)। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন আবার আমার কাছে প্রশ্নপত্রসহ ই-মেইল এসেছে, ইচ্ছে করলে কালকের মিলিয়ে দেখতে পারব, কিন্তু আর রুচি হচ্ছে না।
যারা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চালান, আমি অনুমান করতে পারি, এই দেশের লেখাপড়া নিয়ে তাদের নিশ্চয়ই বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। যদি থাকত তাহলে নিশ্চয়ই এ রকম একটা কিছু ঘটতে দিতেন না।
আমাদের শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণির শিশুদের জন্যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা নেই, আমলারা নিজেদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এটি বের করে জোর করে এটা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবা-মায়েরা আগে আরও বড় হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের কোচিং করতে পাঠাতেন, এখন এই শিশুদেরকেই গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার জন্যে কোচিং করতে পাঠাচ্ছেন।
তাতেই শেষ হয়ে যায়নি– এখন তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হচ্ছে, ছোট ছোট শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো হচ্ছে। সারা পৃথিবীর কোথাও এই নজির নেই, যেখানে একটি রাষ্ট্র তার দেশের শিশুদের অন্যায় করতে শেখায়।
একটা দেশের মেরুদন্ড পুরোপুরি ভেঙে দেওয়ার কি এর চাইতে পরিপূর্ণ কোনো পদ্ধতি আছে? নেই। সারা পৃথিবীতে কখনও ছিল না, ভবিষ্যতেও কখনও থাকবে না।
শুধুমাত্র আমাদের দেশেই কিছু আমলা আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা একটা শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। যে জাতি শৈশবে অন্যায় করতে শিখে বড় হয় সেই জাতি দিয়ে আমরা কী করব?
এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হর্তাকর্তা বিধাতারা, আপনাদের কাছে করজোরে প্রার্থনা করি, আমাদের দেশের শিশুদের আপনারা মুক্তি দিন।
এই শিশুগুলো যদি কোনো পরীক্ষা না দিয়ে শুধুমাত্র বইগুলো নাড়াচাড়া করে সময় কাটিয়ে দিত তাহলে অন্তত তাদের একটা সুন্দর শৈশব থাকত, তারা অন্তত অন্যায় করা শিখত না।
আমাদের শিশুদের লেখাপড়ার দরকার নেই, দোহাই আপনাদের, তাদের ক্রিমিনাল করে বড় করবেন না!
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।