আজ স্কুলে যাব না

অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েছেন নাজিফা আনোয়ার একমাত্র ছেলে সুপ্রিয়কে নিয়ে। প্রায়ই দিনই একেকটা বাহানা করে সুপ্রিয় স্কুলে না যাওয়ার জন্য। এইতো গত রোববার সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য নিজেই রেডি হলো । স্কুলের গাড়িটা যখনই বাসার নিচে এসে হর্ণ দিলো ঠিক তখনই বলতে শুরু করলো মা পেটে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। নাজিফা নিজেই ভড়কে গিয়ে ওকে সেদিন আর স্কুলে যেতে দেয়নি। পরে ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর ডাক্তার জানালেন কোথাও কোন সমস্যা নেই। আজ আবার অন্য বাহানা, আজ বলছে পায়ে ব্যাথা করেছে। যে ছেলে কদিন আগেও একদিনের জন্য স্কুল কামাই করতো না সে হঠাৎ এমন কেনো করছে তা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না নাজিফা।

শুধু নাজিফা নন অনেক অভিভাবকই চিন্তিত বাচ্চার স্কুলে না যেতে চাওয়ার প্রবণতা নিয়ে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি, পেট ব্যথা, বমি বমি লাগছে- এসব অজুহাত দেয় বাচ্চারা। স্কুলে যাওয়ার সময় পার হলেই আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। এ ধরনের সমস্যার নাম স্কুলভীতি। এ রকম সমস্যা অনেক শিশুরই হয়। সাত থেকে শুরু করে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে স্কুলভীতি হতে পারে। তবে সাধারণত সাড়ে সাত থেকে সাড়ে ১০ বছর বয়সের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। প্রথম স্কুলে ভর্তির এক-দুই বছরের মধ্যে অথবা পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে স্কুল পরিবর্তন করা হলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

* প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করলে
* স্কুলের বন্ধুরা কোনো কারণে উত্ত্যক্ত করলে
* নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন পরিবেশে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারলে

* নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হলে, যেমন এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে ভর্তি হলে

* দীর্ঘদিন কোনো কারণে স্কুলে না গেলে

* তীব্র শোক পেলে। যেমন মা-বাবা বা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে

* পরিবারে নতুন ছোট ভাই বা বোন জন্মালে

* স্কুলে কোনো কারণে ভয় পেলে, যেমন শিক্ষকের অতি রূঢ় আচরণ, বন্ধু বা সিনিয়রদের হাতে নিগৃহীত হলে

* স্কুলে কোনো বিশেষ সমস্যা, যেমন বাথরুমে যাওয়া নিয়ে লজ্জা পেলে

* পারিবারিক সমস্যা হলে; মা-বাবার নিত্যদিনের ঝগড়া, ডিভোর্স বা নিকটজনের যেকোনো ধরনের অসুখ হলে

* স্কুলে প্রতিনিয়ত খারাপ ফলাফল করলে বা স্কুলের পড়ার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে

* পরিবারের কোনো সদস্য শিশুর স্কুলে যাওয়াকে ক্রমেই নিরুৎসাহিত করলে

* সেপারেশন অ্যাংজাইটিতে (মা-বাবাকে ছেড়ে থাকা নিয়ে উৎকণ্ঠা) আক্রান্ত হলে

* শিশু কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে (যেমন- বিষণ্নতা, অতি চঞ্চল, অমনোযোগী শিশু, মানসিক প্রতিবন্ধী ইত্যাদি)

শিশুর মধ্যে স্কুলভীতি দেখা দিলে নানা ছুতোয় সে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে; আর যদিও বা স্কুলে যায়, তবে সেখান থেকে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বাসায় চলে আসে। স্কুলভীতির শিশুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা স্কুলের বদলে কেবল বাসায় থাকতেই পছন্দ করে। স্কুল পালিয়ে অন্য কোথাও যায় না। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে পেট ব্যথা, বমি ভাব বা বমির চেষ্টা অথবা বুক ধড়ফড়, মাথা ঘোরা ইত্যাদি সমস্যার কথা বলে স্কুলে যাওয়ার সময়টুকু পার করে দেয়। স্কুলে যাওয়ার সময় পার হয়ে গেলে তার এ সমস্যাগুলোও আর থাকে না। যে শিশুদের মধ্যে স্কুলভীতি থাকে, বড় হয়ে তাদের কেউ কেউ উৎকণ্ঠা (অ্যাংজাইটি) বা অহেতুক আতঙ্কের (প্যানিক ডিজঅর্ডার) মতো মৃদু মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। স্কুলভীতি দূর করার জন্য মা-বাবা ও স্কুলের শিক্ষক- সবাইকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

স্কুলভীতি হলে কী করবেন

* শিশুকে আশ্বস্ত করতে হবে। স্কুল সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে হবে।

* দীর্ঘদিন ধরে স্কুলভীতি থাকে, তবে প্রথমে স্কুল সময়ের বাইরে, যেমন বিকেলের দিকে স্কুলে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। এরপর তাকে স্কুলে অবস্থান করার অভ্যাস করাতে হবে। স্কুল সময়ের বাইরে ও স্কুল সময়ের মধ্যে। দিন দিন তার স্কুলে সময় কাটানোর পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং একসময় তাকে পূর্ণ সময়ের জন্য স্কুলে রাখতে হবে। হসমস্যাটি নিয়ে শিক্ষক বা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।

* শিক্ষকদের উচিত হবে বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকের মতামত শোনা ও চিকিৎসকের পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া।

* অন্যদের চেয়ে তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

* অযথা তাকে কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া যাবে না। ভালো রেজাল্ট করতেই হবে- এমন কোনো টার্গেট বেঁধে দেওয়া চলবে না।

* শিশুকে সাহস দিতে হবে এবং তাকে বোঝাতে হবে যে মা-বাবা তাকে সত্যিই ভালোবাসে। শিশুকে দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলার অভ্যাস করাতে হবে।

* এমন কিছু করা যাবে না, যা তাকে চমকে দেয়। অযথা তাকে সারপ্রাইজ না দেওয়াই ভালো।

* স্কুলের সময় বাসায় এমন কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত নয়, যাতে সে নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে।

* শিশুর সঙ্গে রাগারাগি বা মারধর করা চলবে না; বরং স্কুলে গেলে তাকে ছোট ছোট পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে।

* প্রয়োজনে স্কুল পরিবর্তন করতে হতে পারে।

* সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিশুর সত্যিকারের কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না। থাকলে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে। স্কুলে যেতে না চাওয়া মানেই স্কুলভীতি নয়, অনেক সময় প্রকৃত শারীরিক অসুস্থতার কারণেও সে স্কুলে যেতে অপারগ হতে পারে। এ বিষয়টি ভুললে চলবে না। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

# লেখক পরিচিতি :
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগ

ছবি : আলমগীর হোসেন, মডেল : সামিরা

 

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন