ঐশীর ‘লং ওয়ে টু গো’

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব প্রতিযোগিতায় অনুর্ধ্ব আঠারো বছর বয়সী প্রতিযোগিদের শর্টফিল্ম বিভাগে দ্বিতীয় সেরা হয়েছেন ভিকারুন নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফারহা জাবীন ঐশী। মাত্র দুই মিনিটের একটি অ্যানিমেশন শর্টফিল্ম নির্মাণ করে ঐশী। প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয় তার পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘লং ওয়ে টু গো’।

কী ছিলো তার চলচ্চিত্রে যে হাজারো প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সেরার স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনল সেটি। ঐশী বলেন, ‘চমক দেখানোর মতো তেমন কিছুই ছিলো না আমার চলচ্চিত্রে। আমি শুধু আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নারীদের প্রতি বৈরী সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছি আমার চলচ্চিত্রে।’

‘লং ওয়ে টু গো’র কেন্দ্রীয় চরিত্র একটি মেয়ে। যে ছোটবেলা থেকে অনাদর আর অবহেলার সঙ্গে লড়াই করে সামনে এগুতে থাকে। একটু করে বড় হয় আর নতুন নতুন সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাকে। বাবা-মার বিধি-নিষেধ, পারিবারিক বৈষম্য, স্কুলের পথে ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়া এরকম শত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বপ্ন দেখা ছাড়ে না সে।

তার চোখে বড় হয়ে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। একদিন সত্যি সত্যি সে তার স্বপ্নের জগতে পৌঁছে যায়। দেখতে পায় তার চারপাশের পরিবেশ তার সফলতার সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে বদলে যেতে শুরু করে। বাগানে ফুল ফুটছে, আকাশে সাত রঙা রংধনু। সবই যেনো স্বাগত জানাচ্ছে তাকে।

এমন একটি গল্প কেনো বাছাই করলেন জানতে চাইলে ঐশী জানান, ‘বলতে পারেন চলচ্চিত্রটির চরিত্র আমি নিজেই। আমি আমার চারপাশে যা দেখি তাই তুলে ধরতে চেয়েছি। বাবা-মায়ের কাছে এই বার্তা দিতে চেয়েছি যে একটি মেয়ে চাইলে অনেক কিছু করে দেখাতে পারে। এখন যেমন আমার বাবা-মার কাছে আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি সমাদর পাই। তারা আমার চলচ্চিত্র দেখে বুঝতে পেরেছেন আমি কী চাই। অথবা আমার সমস্যা আসলে কোথায়?’

মেয়ের এই সাফল্যে এখন সমান খুশি মা জামাল আরা এবং বাবা ইকবাল হোসেন। ঐশীর মা জানান, এখন আর মেয়েকে কোনো কাজে বাধা দেই না। ও ওর ছবির মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমি মনে করি এই চলচ্চিত্রটি দেশের প্রত্যেকটি নারীর দেখা উচিত। তার কারণ তাদের সমস্যা এবং সমাধানের কথা এত অল্প সময়েও বেশ ভালোভাবে সে তুলে ধরতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়।

এশীর ছবি বানানোর এই আগ্রহ তৈরি হয় বাবার চীন থেকে একটি ক্যামেরা এনে দেয়ার পর থেকে। সারাদিন সেই ক্যামেরায় ছবি তুলতো এবং ভিডিও করতো সে। গত বছরও শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র জমা নেওয়ার কথা শুনে নিজের স্কুলের বান্ধবীদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে ‘ফ্রেন্ডশীপ’ শিরোনামের একটি শর্টফিল্ম জমা দিয়েছিল। কিন্তু সফলতা ধরা দিলো এবারই প্রথম।

অথচ বাবার অসুস্থতার কারণে এ বছর বাইরে ছবির শুটিং করতে চাইলেও শেষমেষ ঘরে বসেই অ্যানিমেশন ফিল্ম তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অ্যানিমেশন সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না তার। অতএব ইউটিউবই ভরসা। সেখান থেকে অ্যানিমেশন মুভি তৈরির কিছু টিউটোরিয়াল দেখে কয়েকদিনের চেষ্টার পর তৈরি করেন ‘লং ওয়ে টু গো’। 

তার চলচ্চিত্র দেখে প্রথমে নাকি কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি এটা তার তৈরি। অনেকেই জানতে চেয়েছে সে নিজেই তৈরি করেছে নাকি প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য কাউকে দিয়ে বানিয়ে এনেছে? কয়েকদিন রাত জেগে মডেল বানিয়ে, রং মেখে ছবি বানানোর পর সেই ছবি তার নিজের তৈরি কিনা এমন প্রশ্ন করলে কেমন লাগে বলুন! হাসতে হাসতে জানতে চান ঐশী।

প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় সেরা হিসেবে তিনি পেয়েছেন একটি ক্রেস্ট, সনদ আর প্রাইজমানি। যদিও কী একটা ঝামেলায় তা এখনো হাতে এসে পৌঁছেনি তার কাছে। খুব শীগগিরই তার পুরস্কার তিনি বুঝে পাবেন বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

তিনবোনের মধ্যে সবার বড় ঐশী। ফিল্ম তৈরি করা তার শখ। তিনি বলেন, শখের বসে ফিল্ম বানাই। ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন গল্পের বই পড়ি। তার প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং হুমায়ূন আহমেদ। আর প্রিয় পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং তারেক মাসুদ। বড় হয়ে একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন তার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন