ঢাকার রাস্তায় বেপরোয়া কিশােরেরা!

গত ১৬ অক্টোবর মতিঝিলে রাস্তা পার হওয়ার সময় বখাটে কিশোরের মোটরসাইকেল চাপায় নিহত হন রুনা আকতার। এ ঘটনায় বখাটে চালক আলামিনকে ধরে পুলিশেও দেয় জনতা।

গত ১২ অক্টোবর গুলশানে ফারিজ নামের এক কিশোর বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে পথচারী ও রিকশা চালককে চাপা দেয়। এতে চারজন পথচারী আহত হন। ঘটনাটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও গণমাধ্যমে তুমুল আলোচনার ঝড় ওঠে।

শুধু যে এই দুটি ঘটনা তাই নয়। রাজধানী ঢাকা তো বটেই সারাদেশ জুড়েই চলছে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি বা মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামছে। ট্রাফিক আইন না মানা এবং গাড়ি চালানোর অনভিজ্ঞতায় হরহামেশাই দুঘর্টনার শিকার হচ্ছে নিরীহ পথচারী। কখনো কখনো চালক নিজেই গুরুতর অাহত বা প্রাণ হারাচ্ছে।

ঢাকার অভিজাত এলাকায় গাড়ি ও ঢাকার বাইরে মোটর সাইকেল নিয়ে রেসিং বা প্রতিযোগিতা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরদের নিয়মিত ঘটনা। শুধু তাই নয় গাড়িতে এবং মোটরসাইকেলে বিশেষ সাইলেন্সার লাগিয়ে উচ্চ শব্দ সৃিষ্ট করাটাও হাল ফ্যাশন।

স্বচ্ছল অভিজাত পরিবারের এসব কিশোরেরা কেন অল্প বয়সে মাঠ ছেড়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাস্তায় নামছে? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক মনোবিদ ড. মেহতাব খানম বলেন, বয়স এক্ষেত্রে একটি বড় বিষয়। বয়সন্ধিকালে ছেলেরা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য এটা করে। এটা খুবই স্বাভাবিক।

তারা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে তাকে গাড়ি চালাতে দেখে নিজের ভেতরও একটা উৎসাহবোধ করে গাড়ি চালানোর। যাদের বাবা-মার গাড়ি আছে তাদের মধ্যেই এই ধরনের প্রবনতা দেখা যায়। তিনি আরো বলেন, অল্প বয়সে কিশোরদের গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নেওয়ার পেছনে আরো একটি কারণ হচ্ছে তাদের বাবা-মায়েরা।

ছোটবেলা থেকেই অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের খেলনা গাড়ি কিনে দেন। তাতে ওরা খুশি হয়। খেলনা গাড়ি দিয়ে খেলতে খেলতে এক সময় তাদের মধ্যে সত্যিকারের গাড়ি চালানোর অ্যাডভেঞ্চার গড়ে উঠে। তারা ড্রাইভারকে বসিয়ে রেখে নিজেরাই ড্রাইভিং সিটে বসে যাচ্ছে। অনেক সময় বাবা মারা জানেনও না এই বিষয়টা।

বাবা মায়ের নিষেধ কর্ণপাত না করারও কথা জানান এই মনোবিদ। তিনি বলেন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক সময় বাবা-মার কথা মান্যও করছে না। তারা বাবা-মাকে মনে করছে পুরনো। তার কারণ হিসেবে তিনি টেকনোলজিকে দায়ী করেন।

তিনি বলেন, বাচ্চারা আজকাল এতো বেশি টেকনোলজির সাথে জড়িত যে বাবা-মায়ের তাদের সময় দেওয়ার সুযোগ তাদের থাকে না। টেকনোলজির সাথে সম্পৃক্ততার কারণেই অভিজাত ঘরের এসব ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা গড়ে উঠছে।

ঢাকার বনানীতে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মিসেস জেবুননেসা খানম। পেশায় চিকিৎসক এই মায়ের বড় ছেলেটি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করে। তাকে সকালবেলা ড্রাইভার গাড়িতে করে স্কুলে দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে। একদিন তিনি টের পেলেন তার কিশোর ছেলেটি ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় ফিরছে।

পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন ড্রাইভারকে মাঝে মাঝে টিপস দিয়ে গাড়ি চালানোটা রপ্ত করেছে তার কিশাের সন্তান। তিনি জানান, এরপর থেকে ছেলেকে গাড়ি চালাতে নিষেধ করা হলেও তাকে ফাঁকি দিয়ে মাঝে মাঝেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।

অথচ দেশের প্রচলিত আইনেই রয়েছে ১৮ বছর বয়সের নিচে কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। এটা ট্রাফিক ও মোটরযান আইনের স্পস্ট লঙ্গন বলে বলে জানান সাইন্সল্যাব মোড়ে দায়িত্বপালনরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়সের নিচে কারো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ নেই। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো একটি ফৌজদারি অপরাধ।

এটা অপরাধ হলেও তরুণদের এই অপরাধপ্রবণতা কমানো যাচ্ছে না কেনো ? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাবের কারণেই এই অপরাধ প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না। লাইসেন্স ছাড়া এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো কিশোরকে গাড়ি চালানো দেখলে আমরা ট্রাফিক আইনের ৫৭ ধারায় সাধারণ অপরাধে মামলা দিয়ে থাকি। এ ধরনের অপরাধে আমাদের সরাসরি শাস্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র আদালতের। এই সুযোগে তরুণেরা অবাধে গাড়ি চালানোর সুযোগ পাচ্ছে।

টিনেজারদের এই অপরাধপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান চ্যাম্পস টোয়েন্টিওয়ানকে বলেন, নতুন নতুন আইন করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিকভাবেও এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই তরুণদের এই বেপরোয়া অপরাধপ্রবণ ড্রাইভিংয়ের রাশ টানা সম্ভব হবে।

ড. মেহতাব খানমও জানালেন একই কথা। তার মতে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমেই এ ধরনের অবৈধ ড্রাইভিং বন্ধ করা সম্ভব। এটা করা হলে বাবা মায়েরাও অনেক বেশি সচেতন হবে। তারা যদি জানেন যে এ ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না তখন নিজেরাই ছেলেমেয়েদেরকে গাড়ির চাবি হাতে তুলে দেওয়ার আগে কয়েকবার ভাববেন। একই সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সঠিকভাবে স্কুলিংয়ের বিষয়টি দেখভালের পরামর্শও দেন তিনি।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন