সকালে ফ্রিজ খুলতেই পচা গন্ধ পেলো পিকু। আগের রাতে মায়ের তৈরি করা পুডিংটা সাবাড় করবে ভেবে খুলেছিল। কিন্তু পুডিং হাতে নিতে বুঝলো, নষ্ট হয়ে গেছে। আহা ! দারুণ স্বাদ হয়েছিল। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ফ্রিজের ভেতর তাকিয়ে পিকু দেখলো, আলো জ্বলছে না। ভেতরটা গরম হয়ে আছে। ভালো করে দেখে বুঝলো, ফ্রিজে কোনো সমস্যা হয়েছে। যেকারণে পুডিংসহ অনেকগুলো খাবার নষ্ট হয়ে গেছে।
বাসার কাছেই রেফ্রিজারেটর-এসি মেরামত করার দোকান। মাকে বলে এক দৌড়ে সেখান থেকে একটি ছেলেকে নিয়ে এলো পিকু। ছেলেটার বয়স বেশি না, পিকুর চেয়ে বছর চার-পাঁচের বড় হবে। পিকু পড়ে ক্লাস সেভেনে।
ছেলেটাকে দেখে অবশ্য মনে হয় না ফ্রিজ নামক বস্তুটার প্রতি তার কোনো ধারণা আছে। টুকটাক আলাপে নাম জেনে নিল পিকু। তার নাম বাবলু।
ফ্রিজের পেছনে দুই মিনিট কি খটখট করেই বাবলু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কম্প্রেসার গেছে।’
পিকু অবাক হয়ে বলল, ‘কমপ্রেসার! সেটা আবার কি?’
বাবলু হেসে বলল, ‘ও, কমপ্রেসার কি জানো না ? এটা নষ্ট হয়ে গেলে ফ্রিজের ভেতর আর ঠান্ডা থাকে না।’
পিকু একটু লজ্জা পেলো। এটা নিশ্চয়ই খুব দরকারি একটা জিনিস, তার জানা উচিত ছিল ! সে বাবলুকেই জিজ্ঞেস করলো, ‘ না আমি জানি না। একটু বুঝিয়ে বলো না।’
‘বেশ,’ শুরু করলো বাবলু, ‘ কমপ্রেসারকে বলতে পারো ফ্রিজের প্রাণ। হৃদপিন্ড যেমন আমার শরীরের সব শিরা-উপশিরায় রক্ত পৌঁছে দেয়, কমপ্রেসার ফ্রিজের সব চেম্বারে কয়েল দিয়ে একইভাবে গ্যাস পৌঁছে দেয়। এই গ্যাসই ফ্রিজের ভেতরটা শীতল রাখে। আমাদের যেমন রক্ত, ফ্রিজের তেমন গ্যাস।’
‘এই গ্যাস ফ্রিজের কোথায় থাকে? কিভাবে চলাচল করে?’
বাবলু নড়েচড়ে বসলো, ‘ সেটা বোঝার জন্য তোমাকে আগে গ্যাসের একটা মূলনীতি জানতে হবে। যেকোনো গ্যাসকে সম্প্রসারণ করলে সেটার তাপমাত্রা কমে যায়, অর্থাৎ ঠান্ডা হয়। আর সংকুচিত করলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়। অর্থাৎ সরু কোনো পাইপে আবদ্ধ থাকা গ্যাসকে যদি তুমি হঠাৎ একটা বোতলে ছেড়ে দাও, তাহলে দেখবে খুব দ্রুত বোতলটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ফ্রেয়ন নামে একটা গ্যাস আছে যাদের মধ্যে এই ধর্মটা খুবই প্রবল। ফ্রেয়নের আরেকটা নামও আছে—ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন, সংক্ষেপে সিএফসি( CFC )।’
‘ তার মানে কমপ্রেসার এই ফ্রেয়নকে ফ্রিজের সব চেম্বারে ছড়িয়ে দেয় ? সেজন্য ফ্রিজের ভেতর ঠান্ডা থাকে? ’
‘ না পিকু, ব্যাপারটা অতো সহজ না,’ হাসলো বাবলু, ‘ একটা খাতা কলম আনো, তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ’
পিকু বেশ মজা পাচ্ছে। সে এক দৌড়ে খাতা-কলম নিয়ে এলো।
‘ তুমি যেটা বললে, সেভাবে হয়তো মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য ফ্রিজের ভেতর ঠান্ডা রাখা যায়। কারণ কমপ্রেসার যতই পাম্প করুক, ঠান্ডা গ্যাস কিছুক্ষণ পর সাধারণত তাপমাত্রায় চলে আসবে। তাই ফ্রিজের মূলত উদ্দেশ্য একটাই- এমন এক সিস্টেম তৈরি করা যাতে ভেতরে অনবরত ঠান্ডা থাকে।’
বাবলু বলতে থাকলো, ‘কমপ্রেসার আর ফ্রিয়ন ছাড়া ফ্রিজের আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে। একটা হচ্ছে কনডেনসার কয়েল এবং আরেকটা হচ্ছে এক্সপ্যানশন ভাল্ভ।
‘ ফ্রেয়ন শুরুতে ঠান্ডা ও তরল অবস্থায় থাকে। একে কমপ্রেসার টেনে নিয়ে খুব জোরে চাপ দেয় ও সংকুচিত করে ফেলে। এতে ফ্রেয়নের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ও তরল থেকে গ্যাসে পরিণত হয়।
‘এরপর এই উত্তপ্ত গ্যাসকে কমপ্রেসার পাম্প করে কনডেনসার কয়েলের মধ্য দিয়ে পাঠায়। ফ্রিজের পেছনে বা নিচে যেই প্যাঁচানো কয়েল দেখো সেটাই কনডেনসার। এটি গ্যাসের তাপ শুষে নিয়ে তাপমাত্রা কমিয়ে আনে। আর যেহেতু এখানে তাপমাত্রা কমে আসে, তাই ফ্রেয়ন আবার গ্যাস থেকে তরলে পরিণত হয়।’
‘কয়েল কিভাবে তাপ শুষে নেয় ভাইয়া? এই তাপ কোথায় যায়?’
বাবলু হাসলো, ‘ সুন্দর প্রশ্ন করেছো। আসলে তাপ ঠিক শুষে নেয় না, আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, দুটি বস্তু পাশাপাশি রাখলে তুলনামূলক উত্তপ্ত বস্তু তাপ হারায় ও কম উত্তপ্ত বস্তু তাপ গ্রহণ করে। অর্থাৎ ঠান্ডা বস্তু গরম হয়, গরম বস্তু ঠান্ডা হয়। কনডেনসার ঠিক এই সূত্র মেনে কাজ করে। কয়েলের ভেতরের গ্যাস ঠান্ডা ধাতুর স্পর্শে এসে তাপমাত্রা হারায়। সেই তাপ গ্রহণ করে কয়েল উত্তপ্ত হয়, আর ফ্রেয়ন তাপ হারিয়ে তরল হয়ে যায়। এই কয়েল আবার আশেপাশের পরিবেশে তাপ বর্জন করে ঠান্ডা হয়। এজন্যই ফ্রিজের পেছনে সবসময় গরম হয়ে থাকে।
‘তো, যেটা বলছিলাম। কনডেনসারের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ফ্রেয়ন এক্সপ্যানশন ভাল্ভে প্রবেশ করে। এই ভাল্ভের ভেতর চাপ খুব কম থাকে, তাই গ্যাস এখানে সম্প্রসারিত হয়। সম্প্রসারণের কারণে ফ্রেয়নের তাপমাত্রা খুবই কমে -৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পরিণত হয়। এই প্রচণ্ড ঠান্ডা ফ্রেয়ন এক্সপ্যানশন ভাল্ভের অন্যপাশের কয়েলে প্রবেশ করে। একে ফ্রিজার কয়েল বা এভাপোরেটর বলে, এই কয়েল থাকে ফ্রিজের চেম্বারের ভেতরে। এই এভাপোরেটরই চেম্বারের ভেতর ঠান্ডা রাখে।
‘ ফ্রিজার কয়েল দিয়ে যেতে যেতে ফ্রেয়ন আবার বাইরের পরিবেশ থেকে কিছু তাপ অর্জন করে তরলে পরিণত হয়। কমপ্রেসার একে টেনে আনে আগের মতো চাপ দিয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে গ্যাসে পরিণত করে। এই চক্রটি বারবার হতে থাকে।’
এরপর বাবলু খাতায় ছবিটি আঁকলো।
পিকু চোখ বড় বড় করে শুনছিল এতক্ষণ। বাবলুর কথা শেষ হলে বলল, ‘ কি দারুণ ব্যাপার ! তার মানে একটা গ্যাসকেই বারবার গরম থেকে ঠান্ডা করে ফ্রিজ। কমপ্রেসার গরম গ্যাসকে টেনে আনে আর ঠান্ডা গ্যাসকে ছড়িয়ে দেয়।’
‘হ্যাঁ,’মাথা নাড়লো বাবলু, ‘যেহেতু তোমাদের ফ্রিজের কমপ্রেসার নষ্ট হয়ে গেছে, তাই ফ্রেয়ন সেখানে জমে আছে। কনডেনসারের মধ্য দিয়ে যেতে পারছে না। তাই ফ্রিজের ভেতর ঠান্ডা হচ্ছে না।’
‘ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা বাবলু ভাই… তুমি এত কিছু জানো কিভাবে? ’
‘ ফ্রিজের কাজ করি, তাই জানতে হয়। আর কিছুদিন আগে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের বইতে রেফ্রিজারেটরের কাজ করার পদ্ধতি খুব সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে। আরেকটু বড় হলে তুমিও পড়বে।’
পিকু অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি তার মানে পড়াশোনাও করো?’
‘ হ্যাঁ, ’বাবলু হেসে বলল, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু টাকা আয়ের জন্য অবসরে ফ্রিজ-এসি মেরামতের কাজ করি। যে দোকানে আমাকে দেখলে সেটা আমার ছোট মামার দোকান। ছোটবেলা থেকেই এসবের প্রতি আমার অনেক ইচ্ছা দেখে তিনি আমাকে কাজকর্ম শিখিয়েছেন। ফ্রিজের এই কাজ করার পদ্ধতিও তিনিই প্রথম শিখিয়েছেন আমাকে। পরে বইতে পড়েছি।’
পিকু বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। ভাগ্যিস ফ্রিজটা নষ্ট হয়েছিল! না হলে এত কিছু জানতে পারতাম না।’
‘ তোমাকেও ধন্যবাদ শোনার জন্য। ’ এরপর পিকু ভেতরে চলে গেলো আম্মুকে ডাকতে।