শিশুর বড় হয়ে উঠা

আবীর বয়স প্রায় ১০ আর তার ছোট বোন রায়ার ছয় বছর। দুজনে একসঙ্গে স্কুলে যায়, খেলাধুলা করে, টিভি দেখে—খুব মিল তাদের মধ্যে। আবার কখনো একটু ঝগড়াও যে হয় না, তা নয়, কিন্তু এর স্থায়িত্ব কম। মারামারি, ঝগড়ার একটু পরে দেখা যায় দুই ভাইবোন গলাগলি করে একসঙ্গে আবার দুষ্টুমি শুরু করে দিয়েছে৷ অম্লমধুর সম্পর্ক তাদের৷ একজনের জন্য আরেকজনের ভালোবাসার কমতিও নেই। অতুল তার ছোট বোনকে গল্পের বই পড়ে শোনায়, বোনটিও তার স্কুলের নানা ঘটনা ভাইকে বলতে থাকে। একজন আরেকজনের সঙ্গে নিজেদের সব অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেয়।
শিশুর বিকাশে তাদের এই পারস্পরিক সম্পর্কটুকুর গুরুত্ব অনেক বেশি। ছোটবেলায় আরেকজন শিশুর সঙ্গে বিশেষ করে ভাই বা বোনের সঙ্গে সম্পর্ক কী রকম, তা অনেক ক্ষেত্রে শিশুর ভবিষ্যৎ সামাজিক সম্পর্ক নির্দেশ করে। যে শিশু বাড়ি বা স্কুলে আরেক শিশুর সঙ্গে তার আনন্দ-অনুভূতি, ভালো বা মন্দ লাগার বিষয়গুলো ভাগাভাগি করে নিতে শেখে, সে ভবিষ্যতে অনেক বেশি সামাজিক হয়। আবার এর বিপরীতে একা একা বেড়ে ওঠা শিশু, যে বাবা-মা বা বড়দের গণ্ডি পেরোতে পারে না, সে একটা দ্বিধা, শঙ্কা নিয়ে বড় হতে থাকে৷

একা একা বেড়ে ওঠা শিশুর সমস্যা
 পরার্থপর হতে পারে না। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হয়৷
 সামাজিক ভীতি (সোশ্যাল ফোবিয়া) হতে পারে, মানুষজনের মাঝখানে সে হীনম্মন্য বোধ করে৷
 প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হতে পারে৷
 পরিণত বয়সেও তার মধ্যে অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তৈরি হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে।
 তরুণ বয়সে যখন সে চারদিকের প্রতিবেশ আর পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে বেমানান মনে করে, তখন তার মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা; হতাশা থেকে মাদকাসক্তিসহ নানা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে৷
 শিশুটি বড় হলে তার কর্মজীবনে সহকর্মীদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না৷ কর্মক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়৷
 পরবর্তী সময়ে বড় হলে নিজের পারিবারিক জীবনেও সে সম্পর্কের জটিলতার মুখোমুখি হতে পারে৷

সামাজিক বিকাশের জন্য যা প্রয়োজন
ছোটবেলা থেকেই শিশুকে অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে হবে। স্কুলের বাইরেও তার পরিবারের মধ্যে থাকতে হবে তার সঙ্গী। সবচেয়ে ভালো সঙ্গী হচ্ছে নিজের ভাই বা বোন, যার সঙ্গে তার আবেগগুলো ভাগাভাগি করে নেবে।
নিজের ভাই বা বোন যদি না থাকে, তবে চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাইবোন অথবা প্রতিবেশী শিশুর সঙ্গে তাকে মিশতে উৎসাহী করতে হবে।
সব সময় নিরাপত্তার অজুহাতে শিশুকে গণ্ডিবদ্ধ না রেখে তাকে নিজের আবেগগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিন৷
ভাইবোনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে, তাদের নিজেদের মতো করেই আবেগ-অনুভূতি ভাগ করে নিতে উৎসাহী করা জরুরি। তাদের ‘নিজস্ব’ বিষয়ে বাবা-মায়েরা যেন অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ না করেন।
শিশুদের পারস্পরিক সম্পর্কটি হবে অম্লমধুর, আনন্দ-উচ্ছলতার পাশাপাশি কখনো তাদের মধ্যে জন্ম নিতে পারে অভিমান। এই অভিমান মোকাবিলায় তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে। বাবা-মা যেন ন্যায়-অন্যায়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কারও পক্ষ নিয়ে না ফেলেন।
শিশুদের নিজস্বভাবে বেড়ে ওঠাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, যেন তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে আবার চারপাশের জগৎ থেকে আলাদা হয়ে না যায়। এ জন্য পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
শিশুদের পারস্পরিক সম্পর্কের অনুষঙ্গগুলো তার মধ্যে ভবিষ্যতের নানা আবেগ-অনুভূতির ভিত তৈরি করে দেয়। তার মধ্যে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান আর স্নেহের বিষয়গুলোর চর্চা কিন্তু এই ছোটবেলার সম্পর্কটুকুর মধ্যেই নিহিত থাকে। একটি শিশুকে ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে হলে, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে সফল হতে হলে ছোটবেলার এই সম্পর্কগুলোর দিকে অভিভাবকদের অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, এবং ভাইবোন বা আরেকটি শিশুর সঙ্গে এই অম্লমধুর সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ করে দিতে হবে। অতুল আর পুতুলের মতো হাসি– আনন্দ–খুনসুটিতে বেড়ে উঠুক শিশুরা৷ হয়ে উঠুক সামাজিক৷

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন