শিশুশিক্ষায় বইয়ের বোঝা কেন?

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আনন্দময় পরিবেশে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের উপযোগী শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের ওপর বই আর পড়ার চাপ ক্রমেই বাড়ছে।

অভিভাবকরাও ছুটছেন ভালো রেজাল্টের দিকে।

বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনার চাপ কতটা আর কেনইবা এ অবস্থা?

সম্প্রতি শেষ হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ইশমাম আলভী।

পরীক্ষায় সবগুলো বিষয়ে ৯৫ এর উপরে নাম্বার পেলেও শুধু একটি বিষয়ে ৯০ পেয়েছে আলভী। যা সন্তুষ্ট করতে পারেনি তার অভিভাবকে।

তার মা বলছিলেন, “আমি মন খারাপ করেছিলাম। কারণ ছেলের উপর আমার প্রত্যাশা আরো বেশি ছিলো।”

কিন্তু অভিভাবকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য প্রতিদিন কী ধরণের রুটিনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের?

আলভী বলছিলো, ”পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পড়াশোনার চাপ ছিলো অনেক। প্রতিদিন সকাল ৮টায় স্কুল শুরু হতো। আসতাম দুপুরে। বিকেলে কোচিং থাকতো। রাতে বাসায় পড়তাম। খেলাধূলার সময় পেতাম না।”

বাংলাদেশে বিভিন্ন স্কুলগুলোতে শিশুদের পড়াশোনার জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে, সে ব্যবস্থায় শিশুদের উপর পড়াশোনার চাপ বা বইয়ের বোঝা নিয়ে বিতর্ক বা আপত্তি নতুন কিছু নয়।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পিঠে পেটমোটা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা।

ঘন কুয়াশা আর প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ উপেক্ষা করে সকাল সকালই শুরু হয়ে গেছে স্কুলের কার্যক্রম।

অনেক ক্ষেত্রেই ছোট শিশুদের চোখে ঘুম ঘুম ভাব স্পষ্ট।

তাদের বহন করা স্কুলব্যাগই বলে দিচ্ছে প্লে কিংবা নার্সারীতেই এক একটি শিশুকে কি পরিমাণ পড়ার চাপ নিতে হচ্ছে প্রতিদিন।

নার্সারী পড়ুয়া শিশুসন্তানকে নিয়ে স্কুলে আসা আনোয়ারুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলছিলেন,

”সকালবেলা বাচ্চাকে ঘুম থেকে ওঠাতে, রেডি করতে অনেক কষ্ট হয়। ঘুম থেকে তো উঠতেই চায় না। তারপরও জোর করে নিয়ে আসতে হয়। আর বই খাতাও অনেকগুলো। বাচ্চা তো ব্যাগ তুলতেই পারে না।”

বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রাক প্রাথমিকে শিক্ষার স্তর একটি হলেও কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, সেগুলোতে নার্সারী, প্লে, কেজি ওয়ান, কেজি টু’সহ তিন থেকে চারবছর ধরে পড়ানো হয় শিশুদের।

আবার এ সময় শিশুদের খেলায় খেলায় মাতৃভাষা, অক্ষর ও সংখ্যার ধারণা দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের গ্রামার এমনকি বিজ্ঞানও পড়ানো হয়।

পাঠ্যবই থাকে ৬ থেকে ১২টি পর্যন্ত।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠ্যবই নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৩টি।

এছাড়া তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই নির্ধারিত আছে ৬টি করে।

সরকারি স্কুলগুলো এ কারিকুলাম অনুসরণ করলেও বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে কারিকুলামের বাইরে ৭ থেকে ৮টি করে অতিরিক্ত বই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও নির্দেশনা বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “স্কুলগুলোতে কেবল পড়াশোনা, পড়াশোনা আর পড়াশোনা। এর বাইরে যেন আর কিছু নেই। কিন্তু আধুনিক যুগে যারা শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে শিশুর বিকাশ হওয়া দরকার। শিক্ষার চাইতে শিশুর বিকাশটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

সাম্প্রতিককালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী পরীক্ষার কারণে হঠাৎ করেই পঞ্চম শ্রেণিতে চাপ বেড়েছে শিক্ষার্থীদের উপর।

২০১৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি সংগঠন গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে পিইসি পরীক্ষার কারণে স্কুল, প্রাইভেট টিউশনির বাইরে শুধু বাধ্যতামূলক স্কুল কোচিংয়েই বছরে শিক্ষার্থীদের ব্যয় হয় ৪শ ১২ ঘণ্টা করে।

এসব পরীক্ষায় সবকিছু ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে ভালো ফল। এছাড়া অন্যান্য শ্রেণিতেও রয়েছে ক্লাস টেস্টসহ নানা পরীক্ষার চাপ।

শিশুদের উপর পড়াশোনার চাপ বাড়লে তা শিশুর মানসিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. ফারাহ দীবা বলেন,

”আমরা কখনো চিন্তা করি না যে, একটা বাচ্চাকে যদি আমরা এমন কিছু দেই, যা তা বয়সের উপযোগী না, তাহলে এর ফলাফলটা কী হতে পারে। মানুষের মানসিক বিকাশের নানা রকম ক্ষেত্র আছে। আমরা যদি শিশুদের সব ক্ষেত্রে বিকাশের দিকে নজর না দিয়ে শুধু জ্ঞানবিকাশের দিকে ফোকাস ধরে রাখি, তাহলে পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ হলো না।”

তবে স্কুলের শিক্ষকরা আবার অনেক ক্ষেত্রেই পড়াশোনার চাপ বা বাড়তি পরীক্ষার অভিযোগ মানতে চান না।

রাজধানীর আজিমপুরে রায়হান স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ইমরান সাবেরীন বলছিলেন, “পড়াশোনার চাপ আসলে খুব একটা নেই। একটা বাচ্চাকে চর্চার মধ্যে রাখতে, পড়াশোনার লাইনে রাখতে একটা নির্দিষ্ট পরিবেশ দিতে হবে। পরীক্ষা না থাকলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা যা পড়েছে, তা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।”

বাংলাদেশে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষাদানের প্রক্রিয়ানিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনা হয়।

শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক নাজমুল হক বলছেন, শিশুদের পাঠদানের পুরো পদ্ধতিই নতুন করে ঢেলে শিশু উপযোগী করা উচিত।

“শিশু শিক্ষার যে ব্যবস্থাটা আমাদের দেশে রয়েছে, তা যথার্থ নয়। এটার মধ্যে আরো পরিবর্তন আনা দরকার, উন্নতি সাধন করা দরকার। যাতে করে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে পড়তে পারে। এছাড়া পরীক্ষার চাপ থেকে শিশুদের মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের পরীক্ষা থেকে মুক্ত করা যায়।”

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্কুলের পড়া আর অভিভাবকদের চাহিদার চাপে পরে আলভীর মতো শিশুদের সোনালী শৈশবটিই হারিয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। এটা নিয়ে কোন পর্যায়েই দৃশ্যমাণ কোন উদ্যোগও নেই।

লেখাটি বিবিসি বাংলা থেকে সংগৃহীত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন