সংখ্যার বিবর্তন

বর্তমান সময়ে গণনা করার জন্য বিশ্বব্যাপী 0 থেকে 9 এই দশটি সংখ্যা ব্যবহৃত হয়। তবে প্রাচীনকালে কিন্তু আমাদের গণনা করার পদ্ধতি এরকম ছিল না। এমনকি আমাদের পরিচিত সংখ্যাগুলিও ছিল না ! তাহলে তখন মানুষ কিভাবে হিসাব লিখে রাখতো ?

হাজার বছর আগে যখন রোমান সাম্রাজ্যের দাপট ছিল, তখন থেকে ইউরোপে রোমান সংখ্যা ব্যবহার করা হতো। রোমান সংখ্যা আমাদের পরিচিত সংখ্যার মত না হলেও আমরা আজও অনেক জায়গায় এর ব্যবহার দেখতে পাই। যেমন ধরুন পুরনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে অনেক সময় দেখা যায় যে সময়ের ঘরগুলো 1, 2, 3, 4 না হয়ে I, II, III, IV – এমন স্টাইলে লেখা। এমনকি ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের একাদশকেও রোমান স্টাইলে অনেক সময় XI লেখা হয়। প্রাচীনকালে প্রায় ১১০০ বছর ধরে সংখ্যাকে রোমান হরফে লেখা হয়েছে। রোমানরা বিভিন্ন চিহ্নের মাধ্যমে সংখ্যা প্রকাশ করতো। যেমন – I দ্বারা ১, V দ্বারা ৫, X দ্বারা ১০, L দ্বারা ৫০, C দ্বারা ১০০, D দ্বারা ৫০০, M দ্বারা ১০০০ ইত্যাদি। ৩০ লেখার জন্য তিনবার দশ লিখতে হত অর্থাৎ XXX। তবে সমস্যা দেখা দেয় বড় সংখ্যা লেখা নিয়ে। যেমন ধরুন ৯৪৯ সংখ্যাটি লিখতে হত এইভাবে –CMXLIX. আবার ৯৪৯ কে এইভাবেও লেখা যায় – DCCCCXXXXVIIII।ফলে বড় সংখ্যা লেখা ও পড়া কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, প্রথম দিকে রোমান সংখ্যায় শুধু ক্যাপিটাল লেটার ব্যবহৃত করা হলেও পরবর্তীতে পশ্চিম ইউরোপে স্মল লেটারও ব্যবহার করা শুরু হয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি।

রোমান সংখ্যার আরেকটি সমস্যা হলো এখানে একক-দশকের উপস্থিতি নেই। তবে আমাদের বর্তমান গণনা পদ্ধতি মূলত একক-দশকের স্থানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেমন – ৪ এর ডানে দুইটা ০ বসলে সংখ্যাটি হবে ৪০০।

আধুনিক Decimal Place Value সিস্টেম আবিষ্কার করেছিলেন ভারত উপমহাদেশের হিন্দু গণিতবিদরা। ধারণা করা হয় যে, ছয়শ শতাব্দীর দিকে ভারতের গণিতবিদরা শুন্য (০) ব্যবহার করা শুরু করেন এবং সংখ্যার Decimal Place Value সিস্টেম আবিষ্কার করেন। তবে এই সংখ্যা গণনার পদ্ধতি ইউরোপিয়ানদের কাছে পরিচিত করেন আরবরা। মধ্যযুগের মুসলিম গণিতবিদরা এই সংখ্যা পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেন তাদের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গবেষণার দ্বারা। আরব গণিতবিদদের মাঝে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বিখ্যাত পার্সিয়ান গণিতবিদ মোহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারেজমি। তাঁর লেখা বই থেকেই ইউরোপিয়ানরা এই নতুন ও সহজতর সংখ্যা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারে। আরবদের কাছ থেকে জানতে পারায় এই সংখ্যাগুলোকে আজও “অ্যারাবিক নাম্বার” বলা হয়। আল খোয়ারেজমি এর পর আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বই লিখেন। তাঁর লেখা “আল-জাবর ওয়াল মুকাবালাহ” থেকেই আমরা “Algebra” শব্দটি পেয়েছি যা আজও আমাদেরকে স্কুলে শিখানো হয়। আল খোয়ারেজমির বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হতে থাকে। ল্যাটিন ভাষায় তাঁর বই অনুবাদ করার সময় লেখকের নামও ল্যাটিনাইজড করা হয় আর আল খোয়ারেজমির নাম লেখা হয় Algoritimi – যা থেকে বর্তমান অ্যালগরিদম শব্দের উৎপত্তি।

১২০২ খ্রিস্টাব্দে গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি তার বিখ্যাত বই Liber Abaci প্রকাশ করেন। এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি উল্লেখ করেন কেন হিন্দু-অ্যারাবিক নাম্বার ব্যবহার করা উচিত, শুন্যের ব্যবহার ও অ্যালজেবরার বিভিন্ন অ্যালগরিদম যা অ্যারাবিক নাম্বার দিয়ে সহজে করা যাবে।

বর্তমানে 0, 1, 2, 3, 4, 5, 6, 7, 8, 9 এই সংখ্যাগুলো ইউরোপিয়ান সংখ্যা নামেও পরিচিত। অ্যারাবিক সংখ্যাগুলো হিসাব-নিকাশের জন্য আদর্শ হলেও সাধারন মানুষ আজও বিভিন্ন কাজে রোমান সংখ্যা ব্যবহার করে।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন