২৭ আগস্ট, ২০১৫। বেইজিংয়ের বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামে বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জয়ের পর ‘ল্যাপ অব অনার’ দিচ্ছিলেন গতিদানব উসাইন বোল্ট। দর্শকদের অভিনন্দনে সিক্ত হচ্ছিলেন তিনি। তখন ব্যাটারি চালিত দুই চাকার বাহন ব্যবহার করে সেই দৃশ্য ভিডিও করছিলেন টিভির এক ক্যামেরাম্যান। হঠাৎ করে ক্যামেরাম্যানের বাহন ট্র্যাকের পাশে কিছুতে বেঁধে যায় আর ক্যামেরাম্যানসহ হুড়মুড় করে গিয়ে বোল্টের ওপর পড়ে। তৎক্ষণাৎ বোল্ট ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ট্র্যাকের ওপর উল্টে যান। বলতে পারবেন কি এই দুই চাকার বাহন যা ক্যামেরাম্যানের সাথে ছিল?
এই দুই চাকার বাহনটির নাম সেগওয়ে পি.টি যা একজন মানুষকে বহন করতে পারে। সেগওয়ে পি.টি ব্যাটারি চালিত সেলফ-ব্যালেন্সড যন্ত্র যা আবিষ্কার করেন আমেরিকার আবিষ্কারক ডিন ক্যামেন। পি.টি (PT) দ্বারা Personal Transporter বোঝানো হয়। একজন মানুষের সহজ একটি বাহন এমন লক্ষ্য নিয়েই সেগওয়ে তৈরি করা হয়। এটি চালানোও খুব সহজ তবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় খুব সাবধানতার সাথে। সেগওয়েতে চালক একটি প্লাটফর্মে দাঁড়ায় এবং তার দুই হাত থাকে হ্যান্ডবারে। ছোট কম্পিউটার, সেন্সর ও ইলেকট্রিক মোটরের সমন্বয়ে তৈরি সেগওয়েকে সামনে বা পিছে নিতে হলে চালককে শুধু প্লাটফর্মের সামনে বা পিছনে নিজের ভর দিতে হবে। ডানে বা বামে যেতে হলে হ্যান্ডবারকে সেদিকে ঘোরাতে হবে। সেগওয়ে প্রতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্পিড তুলতে পারে।
সেগওয়ে পি.টি প্রথম দেখে অনেকে ধরেই নিয়েছিল যে এটি বাজারে আসার পর গোটা দুনিয়া জয় করে নিবে। সকলের কাছে একটি সেগওয়ে থাকবে। সেগওয়ে প্রস্তুতকারক কোম্পানিও ভেবেছিল তারা আধুনিক যুগের সাইকেল আবিষ্কার করছে যা পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলবে। এমনকি এটি বাজারজাত হওয়ার আগে স্টিভ জবস আর অ্যামাজনের জেফ বেজস এর প্রশংসাও করেছিল। জন ডোয়ের নামক আমেরিকান ক্যাপিটালিস্ট ভবিষ্যতবাণী করেন যে সেগওয়ে ইন্টারনেট থেকেও বেশি জনপ্রিয় হবে! কিন্তু বাজারে সেগওয়ে আসার পর গ্রাহকদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় পণ্য হতে ব্যর্থ হয় এটি। প্রযুক্তিগত দিক থেকে সেগওয়ে সেই সময়ের বিপ্লব হলেও গ্রাহকের কাছে প্রত্যাশিতভাবে জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু কেন?
সেগওয়ের উচ্চ মূল্যের কারণে অনেকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেনি। এছাড়া, রাস্তায় চলা নিয়ে নির্দিষ্ট কোন নিয়মও ছিল না। এমনকি রাস্তার পুলিশরাও ঠিক বুঝতে পারছিল না সেগওয়েকে কিভাবে সামলানো যায়। অনেক সময় পুলিশ বলতো রাস্তায় না চালিয়ে সাইডওয়াক দিয়ে চালাতে, আবার কিছুদুর যাওয়ার পর আরেক পুলিশ বলতো এটি রাস্তায় চালাতে। সেগওয়ে নিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনার খবর পত্রপত্রিকায় আসার পর থেকে মানুষের মনে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ২০০৩ সালে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সেগওয়ে চালানোর সময় ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যান। বুশের এই পতনের ছবি রিপোর্টাররা ঠিকই তুলে নেন এবং তা গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পরে। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ জার্নালিস্ট পিয়েরস মর্গান সেগওয়ে থেকে পরে গিয়ে পাঁজরের ৩টি হাড় ভেঙ্গে ফেলেন। এরপরের খবরটি অনেক বেশি দুঃখজনক। সেগওয়ে কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান জেমস হেসেলডেন নিজেই ২০১০ সালে সেগওয়ে চালানোর সময় দুর্ঘটনার শিকার হন এবং একটি নদীতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন।
সাধারন ক্রেতাদের কাছে সেগওয়ে জনপ্রিয়তা না পেলেও ব্যবসায়ীদের নজর কাড়তে ঠিকই সক্ষম হয়। যেসব পেশায় অনেক বেশি হাঁটার দরকার হয় যেমন শপিং মলের সিকিউরিটি গার্ড, টুরিস্ট গ্রুপ বা বিশাল এয়ারপোর্টের রক্ষনাবেক্ষন কাজে মানুষ সেগওয়ে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুলিশরাও রাস্তায় টহল দেওয়ার কাজে সেগওয়ে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশেও এই বছর পহেলা বৈশাখের সময় রমনা পার্ক এলাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ টহল দেওয়ার কাজে সেগওয়ে ব্যবহার করেছে।