পিঁপড়াবিদ্যা

                                                           ” পিপীলিকা, পিপীলিকা
                                                              দলবল ছাড়ি একা
                                                         কোথা যাও, যাও ভাই বলি।
                                                              শীতের সঞ্চয় চাই
                                                              খাদ্য খুঁজিতেছি তাই
                                                            ছয় পায়ে পিলপিল চলি ” 

নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের “কাজের আনন্দ” কবিতাটির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে ? ছয় পায়ে পিলপিল করে চলা পিপীলিকা বা পিঁপড়াকে আমরা প্রতিনিয়তই দেখে থাকি। বিশেষ করে বাসায় মিষ্টি খাবার রেখে দিলে পিঁপড়ার আনাগোনা দেখা যায়। এছাড়া, পিঁপড়াকে সারিবদ্ধভাবে বা একসাথে দলবেঁধে চলতে দেখা যায়। আজ আমরা ছোট্ট এই পোকা সম্বন্ধে জানবো। 

পিঁপড়া হচ্ছে সামাজিক পোকা। দলবল ছাড়া চলতে পারেনা। তাই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে লাইন ধরে চলাচল করে। পিঁপড়ারা বিভিন্ন রকম ঘরবাড়ি তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ আবর্জনায় বাসা বাধেঁ, কেউ মাটির নিচে, কেউ মাটির উপর, কেউ গাছে আবার অনেকেই কোন বাসাই তৈরি করে না। শস্যসংগ্রাহী পিঁপড়ার এক প্রজাতির পিঁপড়াই সবচেয়ে ছোট দুর্গ তৈরি করে থাকে। তাদের সুরঙ্গ ১৫ ফুট পর্যন্ত গভীর হয়ে থাকে। শীতকালিন নিদ্রার জন্যই তারা এই ব্যবস্থা করে থাকে। কিছু পিঁপড়া উই পোকাদের মতো কাঠে বাস করে।

পিঁপড়ারা যেখানে বাস করে তাদের পিঁপড়ে কলোনি বলে। একটা কলোনিতে একজন রানী পিঁপড়া, কয়েকজন ছেলে পিঁপড়া আর অসংখ্য কর্মী পিঁপড়া থাকে। কর্মী পিঁপড়ারা রানী আর বাচ্চা পিঁপড়ার দেখাশোনা করে। মাঝ বয়সে ওরা বেরোয় খাবার খুঁজতে। আর শেষ বয়সে ওরা সৈনিকের দায়িত্ব পালন করে। তখন ওরা পিঁপড়া কলোনির নিরাপত্তা বজায় রাখে।

এক কলোনির পিঁপড়েরা অনেক সময় অন্য কলোনি আক্রমণ করে বসে। আক্রমণ করে অন্যদের জমানো খাবার, আর বাচ্চাদের নিয়ে যায়।

সাধারন ভাবে পিঁপড়ারা ৭ বছর পর্যন্ত বাঁচে কিন্তু রানী পিঁপড়া ১৫ বছরের মতো বাঁচতে পারে। তারা খুব ব্যস্ত সময় কাটায়। পিঁপড়ারা দলবদ্ধভাবে খাবার সংগ্রহ, এবং যুদ্ধ করে থাকে। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তারা তাদের দলের সাথে কাটায়। কেউ কেউ খাবার হিসেবে কাঠ খুব পছন্দ করে কেউ আবার তৃণ পছন্দ। সবধরনের শস্যই তারা পছন্দ করে । চিনির বা মিষ্টির প্রতি তাদের আছে আলাদা আকর্ষন।

পিঁপড়াদের জীবন চারটি স্তরে বিভক্ত। ডিম,লার্ভা,পুপা ও পুর্নাঙ্গ পিঁপড়া। ডিমগুলো থেকে উৎপন্ন হয় লার্ভা। লার্ভা পর্যায়ে তাদের কোন চোখ,কিংবা পা কোনটাই থাকেনা। কিন্তু তারা খাবার খেতে পারে। বড় পিঁপড়া তাদের খাবার খাওয়ায় সাহায্য করে। লার্ভাগুলি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং অনেকটা মন্ডের আকার ধারন করে,উপরে একটি নতুন চামড়া তৈরি হয়। তখন দেখতে অনেকটা রেশমের গুটির মতো দেখায়। এটাকেই পুপা দশা বলে। পুপা আবস্থার পর যখন পুর্নাঙ্গ পিঁপড়ায় রুপান্তরিত হয়, পিঁপড়ারা তখন তাদের এই খোলস কেটে পিঁপড়াদের বের হয়ে আসতে সহায়তা করে। প্রথম আবস্থায় তাদের দেহ কিছুটা ধূসর সাদা থাকে। কয়েক ঘন্টা পরেই তারা চলাচল শুরু করে।তারা অল্প কয়েক দিনেই বড় হয়ে যায়। পিঁপড়া ডিম থেকে পূর্ণ বয়স্ক হতে তিনমাসের মতো সময় লাগে। পিঁপড়ার এই পরিবর্তন বিজ্ঞানের ভাষায় পিঁপড়ার রুপান্তর বলে।

Ant Nest
ছবি : সংগৃহীত

পিঁপড়ার শরীর প্রধানত তিনটি অংশে ভাগ করা থাকে মাথা, মধ্যশরীর(শরীরের মধ্যবর্তী অংশ),পশ্চাৎদেশ।  পিঁপড়ার থাকে ছয়টা পা। সবগুলো পা শরীরের মধ্যবর্তী অংশের সাথে সংযুক্ত থাকে।

মাথার অংশে থাকে চোয়াল( মুখ), চোখ, এবং এন্টেনা ( কীটপতঙ্গের মাথার জোড়া শুঁড় যা তাদের অনুভব-ইন্দ্রিয়ের কাজ করে। তাদের চোখ অনেকগুলো লেন্সের সমন্বয়ে তৈরি তাই তার যে কোন নাড়াচাড়া খুব ভালভাবে দেখতে পারে। তাদের এন্টেনাটা বিশেষ ভাবে তৈরি । তারা এন্টেনা দিয়ে ঘ্রাণ নেয়া, স্পর্শ করা, স্বাদ নেয়া এমনকি শুনতেও পারে। পিঁপড়ারা তাদের এন্টেনার দিয়ে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করে। পশ্চাৎদেশে তাদের পেট এবং মলদ্বার থাকে। অনেক প্রজাতির পিঁপড়ার পশ্চাৎদেশে বিষাক্ত হুল থাকে যা তাদের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে।

পিঁপড়াদের কোন ফুসফুস থাকেনা। ক্ষুদ্র এক ছিদ্র দিয়ে অক্সিজেন গ্রহন এবং কার্বন-ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। পিঁপড়াদের রক্তের কোন রং নাই। তাদের হৃদপিন্ড অনেকটা লম্বা টিউবের মতো। তাদের রক্তে এক ধরনের রস থাকে যা হৃদপিন্ড পরিশোধন করে আবার মাথায় ফেরত পাঠায়। পিঁপড়ার স্নায়ু তন্ত্র দীর্ঘ স্নায়ু তন্তু দিয়ে গঠিত। এটা অনেকটা মানুষের মেরুদন্ডের ভেতরের স্পাইনাল কর্ডের মতো কাজ করে।

পিঁপড়ারা জীবনের নানান স্তরে নানান ধরনের খাদ্য খেয়ে থাকে। ছোট লার্ভারা বড় পিঁপড়াদের কাছ থেকে এক ধরনের তরল খেয়ে থাকে। বড় পিঁপড়ারা বাহির থেকে যে শস্য সংগ্রহ করতে পারে তাই খায় এবং সংগ্রহ করে কলোনিতে নিয়ে আসে। সংগ্রহিত খাবার ছোটদের খাবার উপযুক্ত তরল করে দেয় যাতে তা সহজে খেতে পারে। বড় হয়ে যাবার পর কিছু কিছু পিঁপড়া খাবার খেতে পারে না কারণ তাদের চোয়াল কেবল তাদের কাজের উপযোগী হয়ে তৈরি হয় কিন্তু খাবার খাওয়ার জন্য নয়।

পিঁপড়ের শরীর থেকে ফেরোমোনেস (Pheromones) নামক এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ বের হয়। যখন ওরা কোথাও যায় তখন সারা রাস্তায় ওটা লেগে থাকে। ফেরার সময় সেই গন্ধ শুকে শুকে পিপঁপড়ারা কলোনিতে ফিরে আসে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহ করে এখানে আপনার নাম লিখুন