কেএফসি। সারাবিশ্ব তো বটেই আমাদের বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের কাছেও খুব জনপ্রিয় খাবারের দোকান। একটু ফুসরত পেলেই আমরা ছুটে যাই ফাস্টফুডের স্বাদ নিতে। আজ যে মানুষের মধ্যে ফাস্টফুডের প্রতি এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়েছে তার পেছনেও রয়েছে কেএফসির ভূমিকা। আজ যারা কেএফসির খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি তাদের কজনই জানি কী করে গড়ে উঠল কেএফসি। আর কীভাবেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সারাবিশ্বে।
কেএফসির পুরো নাম ‘কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন’। কর্ণেল হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স কেএফসি বা কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামের আগে কর্ণেল পদবী থাকলেও তিনি সেনা সদস্য ছিলেন না। তবে কেএফসি প্রতিষ্ঠার আগে তিনি দুনিয়ার এমন কোনো কাজ নেই যার সঙ্গে জড়াননি।
খুব ছোটবেলাতেই স্কুল থেকে ঝরে পড়েন ডেভিড। এরপর কাজ করেছেন খেত মজুরের, ট্রেনের ফায়ারম্যান, সেলসম্যান, আইনজীবি, গাড়ির টায়ার বিক্রেতা, ফিলিং স্টেশনের কর্মচারি হিসেবে। শুধু কি তাই? শখের বসে বেশ কিছুদিন ধাত্রী বিশারদের কাজও করেছেন। নাম লিখিয়েছিলেন রাজনীতিতেও। শেষমেষ তিনি নেমে পড়েন রেস্তোরা ব্যবসায়!
কর্ণেল স্যান্ডাসের জন্ম ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। বাবা উইলবার ডেভিড ও মা মার্গারেট অ্যানের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। এক দুর্ঘটনায় স্যান্ডার্সের বাবার পা ভেঙ্গে যায়। তার দুই বছর পরে ১৮৯৫ সালে মারা যান তার বাবা। তার বাবার মৃত্যুর কয়েক বছর পর আবার বিয়ে করেন স্যান্ডার্সের মা মার্গারেট অ্যান।
সৎ বাবার পরিবারে পড়ে থাকতে ভালো লাগেনি স্যান্ডার্সের। ১৯০৩ সালে স্কুল ছেড়ে দিয়ে এক খামারে কাজ শুরু করেন। এরপর চাকরি নেন ইন্ডিয়ানা পুলিশ বাহিনীর ঘোড়ার গাড়ি রং করার।
১৪ বছর বয়সে একটি খামারে খেতমজুরের কাজ করেন দুই বছর। সেখান থেকে মায়ের অনুমতি নিয়ে ১৯০৬ সালে ইন্ডিয়ানার নিউ আলবানিতে একটি গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে চাকরিরত তার চাচার সঙ্গে দেখা করেন। চাচা তাকে ওই কম্পানিতেই কন্ডাক্টরের চাকরি দেন।
এখানে বছরখানেক চাকরি করে আলবামার আরেক অঞ্চলে তার আরেক চাচার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সেখানে স্যান্ডার্সকে একটি কামারশালায় ঢুকিয়ে দেন। এখানে দুইমাস যেতে না যেতেই আরেক এলাকা জাসপারে কয়লাচালিত ট্রেনের ছাইয়ের টাংকি পরিস্কারের কাজ নেন। তার যখন ১৬ বছর বয়স তখন কাজ পান ফায়ারম্যানের। এর মধ্যে কাজ জুটিয়ে নেন নর্থফোক এবং ওয়েস্টার্ন রেলস্টেশনে দিনমজুরের।
স্যান্ডার্সের এক জায়গায় বেশিদিন কাজ করার অভ্যেস ছিলো না। দুই বছর পর আবার তিনি ফিরে যান ইলিনয় সেন্ট্রাল রেলরোডে। কাজ নেন ফায়ারম্যানের। এরপর তিনি এক্সটেনশন ইউনিভার্সিতে আইন পড়তে শুরু করেন। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে লিটল রক নামের একটি আইন প্রতিষ্ঠানে বছর তিনেক প্র্যাকটিস করে বেশ কিছু টাকা আয় করেন স্যান্ডার্স।
টাকার মায়ায় বাধা না পড়ে আইন পেশাকে বিদায় জানিয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসেন। ১৯১৬ সালে চাকরি নেন একটি বীমা কোম্পানিতে। তবে সেই চাকরি হারানোর পর বেশ কিছুদিন সেলসম্যানের কাজও করেছেন।
১৯২০ সালে তিনি একটি নৌকা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার প্রতিষ্ঠান নদীতে চলাচলকারী ডিঙ্গি নৌকা বিক্রি করতো। একই সঙ্গে ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ানার চেম্বার অব কমার্সে চাকরি নেন। কিন্তু এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। শুধু তাই নয় ডিঙ্গি নৌকার প্রতষ্ঠিাসটিও বিক্রি করে দেন ৩৩ হাজার ডলারে।
এরপর পাড়ি জমান কেন্টাকি রাজ্যের উইনচেস্টারে। এখানে এক টায়ার কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি নেন। ১৯২৪ সালে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে গেলে তার সঙ্গে পরিচয় হয় কেন্টাকির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে। তিনি তাকে নিকোলাসভ্যালির এক সার্ভিস স্টেশনে চাকরি দেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো ১৯৩০ সালে স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়।
কোনো কুল কিনারা না পেয়ে এ সময় তিনি ভোক্তাদের খাবার সরবরাহের কাজ শুরু করেন। তখন তো এখনকার মতো ঝা-চকচকে দামী কোনো রেস্তোঁরা ছিলো না। নিজের বাড়িতেই কাজ শুরু করেন। এ সময় তার খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলে ১৯৩৯ সালে নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যাশেভ্যালিতে একটি মোটেল ভাড়া নেন স্যান্ডার্স। দুর্ভাগ্য ওই বছরই নভেম্বর মাসে আগুন লেগে দোকানটি পুরোপুরি পুড়ে যায়।
জীবন যার সংগ্রামে গড়া তিনি পিছু হটে যাবেন কোনো? এবার তিনি মোটেলটিকে ১৪০ আসনের একটি রেস্টুরেন্টে রুপ দেন। ১৯৫২ সালে স্যান্ডার্স ‘চিকেন ফ্রাই’ ধারণাটাকে তার আয়ের উৎসে পরিণত করার উদ্দেশ্যে একটি উপযুক্ত রেস্তোরা খোঁজা শুরু করেন। না পেয়ে শেষমেষ স্যান্ডার্স ও তার স্ত্রী মিলে সেলবাই ভ্যালিতে একটি রেস্টুরেন্ট খুলে বসেন। একটি ইতিহাসের গোড়াপত্তন ঘটে এর মাধ্যমে। সেই রেস্তোরাই আজকের কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন। যা কেএফসি নামে সারাবিশ্বে পরিচিত।
১৯৫৫ সাল থেকে মাত্র দশ বছরের মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেএফসির ৬০০ টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে তিনি তার রেস্তোরাকে আমেরিকান এক কম্পানির কাছে দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দেন। ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র : উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট